গুরুর আরাধনা
गुरोराराधनं कृत्वा सर्वमर्हत्यसाधकः।
गुरुं विना न जानाति मन्त्रं योगं च साधनम्॥
(कुलार्णव तन्त्र, उल्लास २, श्लोक ७)
বাংলা অনুবাদ: “গুরুর আরাধনা না করলে সাধক সমস্ত কিছু অর্জন করতে পারে না। গুরু ব্যতীত সে মন্ত্র, যোগ অথবা সাধনার কিছুই জানে না।”
এই উদ্ধৃতিই স্পষ্ট করে দেয়, গুরু ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। শুধুমাত্র শাস্ত্রপাঠ করে, অথবা মন্ত্র মুখস্থ করে কোনও সিদ্ধি আসবে না, যদি না তার পেছনে গুরুর শুদ্ধ দীক্ষা ও কৃপা থাকে।
উপনিষদীয় গুরুবোধকে আরও একটি চরম ও ব্যক্তিগত মাত্রায় নিয়ে যায়। भगवद्गीता–য় বলা হয়েছে—
तद्विद्धि प्रणिपातेन परिप्रश्नेन सेवया।
उपदेक्ष्यन्ति ते ज्ञानं ज्ञानिनस्तत्त्वदर्शिनः॥
(भगवद्गीता ४.३४)
বাংলা অনুবাদ: “তুমি তাঁকে নম্রভাবে প্রশ্ন করো, সেবা করো। সেই জ্ঞানীরা তোমাকে তত্ত্বজ্ঞান দান করবেন।”
গুরু হলেন साक्षात् परब्रह्म—জড় ও চেতন সত্তার মধ্যে সেতু।
गुरुरेव परं ब्रह्म तस्मात् सर्वं गुरुं स्मरेत्।
(कुलार्णव तन्त्र, उल्लास ११, श्लोक ४७)
বাংলা অনুবাদ: “গুরুই পরব্রহ্ম, অতএব সর্বদা গুরুর স্মরণ করা উচিত।”
শাস্ত্রে বহুবার স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে—গুরু ছাড়া মন্ত্র নিষ্ফল, দীক্ষা অবৈধ, এবং সাধনা অনিষ্টকর। কুলার্ণব তন্ত্রে একাধিক শ্লোকে এই বক্তব্য উঠে এসেছে। বলা হয়েছে—
मन्त्रार्थं नैव जानीते गुरोर्यः नाज्ञया जपेत्।
स सर्वं निष्फलं मन्ये व्यर्थं जन्म कथं भवेत्॥
(কুলার্ণব তন্ত্র, উল্লাস ১৫, শ্লোক ১৭)
বাংলা অনুবাদ: “যে গুরু অনুমোদন ব্যতীত মন্ত্র জপ করে, সে মন্ত্রের অর্থই বোঝে না; আমি বলি তার সমস্ত সাধনা ব্যর্থ এবং এমন জন্ম বৃথা।”
শাস্ত্রে কথিত আছে—দীক্ষা ব্যতীত মন্ত্র মৃতপ্রায়। যেমন অগ্নিহীন হোম, তেমনই গুরুবিহীন সাধনা। শাক্তসংহিতা, তন্ত্ররাজতন্ত্র এবং শ্রীকুলতন্ত্র–সহ বহু গ্রন্থে একথা পুনঃপুনঃ উচ্চারিত হয়েছে।
রাজতন্ত্রে বলা হয়েছে—
गुरुमुखादृते मन्त्रः स्वयञ्चेत्तत्र सिद्ध्यति।
तं मन्त्रं पिशाचज्ञं प्रेतसिद्धिं स विन्दति॥
(তন্ত্ররাজতন্ত্র, অধ্যায় ৭, শ্লোক ১১)
বাংলা অনুবাদ: “গুরুমুখ ব্যতীত যে মন্ত্র নিজে জপ করা হয়, তা যদি সিদ্ধিও দেয়, তবে তা প্রেতসিদ্ধি মাত্র; আত্মসিদ্ধি নয়।”
এই শ্লোকটি এক অনুপম সতর্কবাণী। গুরুর আশীর্বাদ ছাড়া কোনো মন্ত্র যদি ফল দেয়ও, তবে তা বিশুদ্ধ নয়; তা প্রায়ই নিম্নচেতনার শক্তি জাগিয়ে তোলে—যা অশুভ ফল এনে দিতে পারে।
শ্রীকালিসংহিতায় গুরু সম্বন্ধে বলা হয়েছে—
गुरुः शिवः गुरुर्देवो गुरुर्ज्ञानप्रदायकः।
गुरुर्बीजं गुरुर्मन्त्रः गुरुर्देवि सदा स्मृतः॥
বাংলা অনুবাদ: “গুরুই শিব, গুরুই দেবতা, গুরুই জ্ঞানদাতা, গুরুই বীজ, গুরুই মন্ত্র, গুরুই দেবী—তাঁকেই সর্বদা স্মরণ করতে হয়।”
এই শ্লোকটি তন্ত্রসাধনার অভ্যন্তরে গুরুর বহুমাত্রিক উপস্থিতিকে তুলে ধরে। তিনি শুধু দীক্ষাদাতা নন, তিনিই মন্ত্রের প্রাণ, শক্তির প্রবাহ, এবং চেতনার উৎস।
श्रोत्रियोऽवृजिनोऽकामहतो यो ब्रह्मवित्तमः।
ब्रह्मण्युपशमाश्रयः॥
(मुंडक उपनिषद् १.२.১২)
বাংলা অনুবাদ: “যিনি শাস্ত্রজ্ঞ, পাপহীন, আকাম, ব্রহ্মজ্ঞ এবং উপশমাশ্রিত—তিনিই উত্তম গুরু।”
এই শ্লোকটি একে একে চারটি মৌলিক গুণ নির্ধারণ করে:
(১) শ্রোত্রিয়—যিনি বৈদিক শাস্ত্রে পারদর্শী
(২) অবৃজিন—অসচ্চরিত্র নন
(৩) আকামহত—যাঁর ভিতরে কামনাবাসনা নেই
(৪) ব্রহ্মবিত্তম—যিনি ব্রহ্মজ্ঞ
এই চারটি গুণের সংযোজনে সেই গুরু জন্ম নেন যিনি প্রকৃত নির্দেশক, যাঁর কাছে শিষ্য নিরাপদ, সংরক্ষিত ও আলোকিত।
গুরুগীতায় এক অনবদ্য শ্লোক রয়েছে—
ज्ञानशक्तिसमायुक्तो गुरुर्ब्रह्म न संशयः।
अणुमात्रं न संशयोऽस्ति तस्मात्संपूज्यो हि तत्त्ववित्॥
(গুরুগীতা, শ্লোক ৩৮)
বাংলা অনুবাদ: “যিনি জ্ঞান ও শক্তির সহিত যুক্ত, তিনিই গুরুরূপে ব্রহ্ম; এতটুকুও সন্দেহ নেই। তাই তিনি পূজার যোগ্য।”
যোগবাসিষ্ঠ-এ বলা হয়েছে—
गुरुरप्यग्रजो वृद्धो यश्च स्यादात्मनिष्ठया।
तं नमस्येत्तथा नित्यं स एव परमेश्वरः॥
(যোগবাসিষ্ঠ, নির্বাণ প্রকারণ, অধ্যায় ২)
বাংলা অনুবাদ: “যে গুরু আত্মনিষ্ঠ, তিনি বয়সে ছোট হোন বা বড়, তাঁকে নিত্যপ্রণাম করতে হয়; তিনিই পরমেশ্বর।”
তাই গুরু নির্বাচন করা মানে কেবল একজন শিক্ষক খোঁজা নয়; এটি এক সার্বিক আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত—যেখানে শিষ্য নিজের হৃদয়, সংস্কার, মনন ও ভবিষ্যৎ, সমস্ত কিছু এক যোগ্য, সিদ্ধ, শক্তিসংযোজিত আত্মার হাতে তুলে দেন।
এই প্রসঙ্গে শ্রীগুরুগীতা এক বিস্ময়কর সত্য প্রকাশ করে—
शिष्यं चित्ते स्थितं कृत्वा गुरुः कार्यं समाचरेत्।
यत्नात्तस्य विकासार्थं गुरुर्वाक्यं प्रवर्तयेत्॥
(গুরুগীতা, শ্লোক ৬৮)
বাংলা অনুবাদ: “শিষ্যকে নিজের চিত্তে স্থাপন করে গুরু কর্ম সম্পাদন করেন। তাঁর বিকাশের জন্য গুরু নিজের বাক্যে সদা সচেষ্ট থাকেন।”
গুরুদীক্ষাকে তুলনা করা হয়েছে কৃষকের সঙ্গে—গুরু হলেন বীজ বপনকারী, আর শিষ্য হলেন সেই ভূমি, যেখানে মন্ত্ররূপী বীজ অঙ্কুরিত হয়।
गुरोरादेशतः शिष्यः संस्कारं समवाप्य च।
मन्त्रेण दीक्षितः पश्चाद्विविक्ते देशके शुभे॥
(কুলার্ণব তন্ত্র, উল্লাস ১২)
বাংলা অনুবাদ: “গুরুর আদেশে শিষ্য যখন সংস্কার প্রাপ্ত হয় এবং মন্ত্র দ্বারা দীক্ষিত হয়, তখনই সে সদ্গতিতে প্রবিষ্ট হয়।”
এই সংস্কার, বা শোধন, গুরু নিজ হাতে সম্পন্ন করেন।
शक्तिपातं विना मन्त्रः निष्फलो मृगवन्मतः।
गुरोराज्ञाविना न स्यात्सिद्धिर्मन्त्रस्य दुर्लभा॥
বাংলা অনুবাদ: “শক্তিপাত ব্যতীত মন্ত্র পশুর মত; গুরুর অনুমতি ব্যতীত মন্ত্রে সিদ্ধি অসম্ভব।”
শাস্ত্রে আছে, যদি কোনও গুরু অযোগ্য শিষ্যকে দীক্ষা দেন, তবে তার কুফল গুরুকেই ভোগ করতে হয়। এজন্যই কুলার্ণব তন্ত্রে বলা হয়েছে—
अदातव्यं गुरुर्बीजं बुद्धिहीनाय पामराय।
दत्ते ह्युपरि पापानि पतन्त्यस्य गुरोर्ध्रुवम्॥
(কুলার্ণব তন্ত্র, উল্লাস ১৩)
বাংলা অনুবাদ: “যিনি অযোগ্য, জ্ঞানহীন, পামর—তাঁকে বীজমন্ত্র দান করা উচিত নয়। করলে সেই পাপ গুরুর উপরই পতিত হয়।”
এই গুরু-শিষ্যের দীক্ষাসূত্র তাই এক অত্যন্ত পবিত্র এবং ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তি। গুরু একদিকে শিষ্যের অন্তরে আলো জ্বালান, অপরদিকে নিজেও সেই আলোর ভার বহন করেন। এই দীক্ষাই শিষ্যের জীবনে স্থাপন করে নতুন সময়রেখা—যেখানে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে গুরু হয়ে ওঠেন এক অন্তর্বর্তী সেতু।
কুলার্ণব তন্ত্রে এ বিষয়ে কঠোর ভাষায় বলা হয়েছে:
धनार्थं यो गुरुत्वं करोति, न स गुरुः।
कामिनं लोलुपं मूढं त्याज्यं दूरात्सदा बुधैः॥
(কুলার্ণব তন্ত্র, উল্লাস ১৪)
বাংলা অনুবাদ: “যে অর্থের জন্য গুরুর ভান করে, কামপ্রবণ, লোভী ও মূর্খ—তাঁকে জ্ঞানীরা সর্বদা দূর থেকে ত্যাগ করেন।”
এই প্রসঙ্গে গুরুগীতা এক ভয়াবহ সতর্কবাণী উচ্চারণ করে—
वेशधारी महापापी गुरुवेशं समाश्रितः।
मूढास्तं नमस्यन्ति नरकं याति निश्चितम्॥
(গুরুগীতা, শ্লোক ১৭৬)
বাংলা অনুবাদ: “যে গুরুর বেশে মহাপাপী, তাকে যারা মূঢ়ভাবে নমস্কার করে, তারা অবধারিতভাবে নরকে পতিত হয়।”
কুলার্ণব তন্ত্রে এমন গুরুদের জন্য চরম ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে—
गुरुप्रायो गुरोरनर्हो यो न विद्याव्रतो महान्।
स गुरुः किल न ज्ञेयो राक्षसो गुरुवेषधृक्॥
(কুলার্ণব তন্ত্র, উল্লাস ১৪)
বাংলা অনুবাদ: “যিনি জ্ঞান, ব্রত ও শুদ্ধতায় মহান নন, তাঁকে গুরু বলা যায় না; তিনি রাক্ষস, গুরুর বেশধারী মাত্র।”
গুরুর পূজায় মুখ্য হল চিত্ত-নিবেদন। তিনি যেহেতু জড় নন, তাই বাহ্যিক উপাচারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল আন্তরিকতা, ভক্তি, এবং নির্ভরতা। গুরুর আসনে যখন পূজা অর্পণ করা হয়, তখন সেখানে আসলে অর্পণ করা হয় ব্রহ্মচৈতন্যকে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
अखण्डमण्डलाकारं व्याप्तं येन चराचरम्।
तत्पदं दर्शितं येन तस्मै श्रीगुरवे नमः॥
(গুরু স্তোত্র)
বাংলা অনুবাদ: “যিনি সমগ্র চরাচর জগতের অন্তরালে সেই অখণ্ড তত্ত্বকে দর্শন করিয়েছেন, তাঁকে আমি প্রণাম জানাই।”
গুরুগীতায় বলা হয়েছে—
सर्वतीर्थं समं स्थलं सर्वदेवमयो गुरु।
सर्वमन्त्रस्वरूपश्च सर्वदर्शी न संशयः॥
(গুরুগীতা, শ্লোক ৮৭)
বাংলা অনুবাদ: “সমস্ত তীর্থ, সমস্ত দেবতা, সমস্ত মন্ত্র ও দর্শন—সবকিছুর একত্র রূপ হলেন গুরু।”
শাস্ত্র বারবার এই কথাই বলে—গুরু মানে কেবল একজন পঠন-পাঠনের মানুষ নন, তিনি এক চেতনার ক্ষেত্র। তিনি এক চলমান অগ্নি, যাঁর সংস্পর্শে শিষ্যের মায়িক অস্তিত্ব দগ্ধ হয়ে তার অন্তর্নিহিত দেবত্ব জাগে।
गुरुः परतरं नास्ति त्रैलोक्ये सचराचरे।
गुरुं सम्यगविज्ञाय स्वात्मारामो भवेत्पुमान्॥
(কুলার্ণব তন্ত্র, উল্লাস ১১)
বাংলা অনুবাদ: “ত্রিলোকের মধ্যে গুরুর চেয়ে উচ্চতর কিছু নেই। যিনি গুরুকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করেন, তিনি আত্মার আনন্দে প্রতিষ্ঠিত হন।”
न गुरोरधिकं तत्त्वं न गुरोरधिकं तपः।
तत्त्वज्ञानात् परं नास्ति तस्मै श्रीगुरवे नमः॥
(स्कन्दपुराण, गुरुगीता, श्लोक ১১৭)
বাংলা অনুবাদ:
“গুরুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনও তত্ত্ব নেই, গুরুর চেয়ে বড় কোনও তপস্যা নেই। তত্ত্বজ্ঞানই পরম; আর যিনি সেই জ্ঞানের আধার, সেই গুরুকে আমি প্রণাম জানাই।”