বেদ কী?
‘বেদ’ শব্দটি এসেছে ‘বিদ্’ ধাতু থেকে, যার অর্থ জানা, উপলব্ধি করা, আত্মবোধ লাভ করা। বেদ হচ্ছে সেই চিরন্তন, অনাদি ও অপৌরুষেয় জ্ঞান, যা ব্রহ্মার হৃদয়ে স্বয়ং ভগবান প্রবিষ্ট করান সৃষ্টির শুরুতেই। মানব জীবনের সর্বোচ্চ কল্যাণ ও মুক্তির পথ বেদে নিহিত।
বেদ কোন মানুষ রচিত গ্রন্থ নয়, এটি শ্রুতি, অর্থাৎ যা শোনা যায়, ঈশ্বরীয় অনুপ্রেরণায় ঋষিগণ অন্তর্দৃষ্টিতে যা উপলব্ধি করেন।
বেদের জ্ঞানভাণ্ডার চারটি মূল ভাগে বিভক্তঃ-
1. ঋগ্বেদ :---- এটি প্রাচীনতম বেদ। এতে রয়েছে দেবতাদের স্তব ও প্রশস্তি, অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ, সূর্য প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তিকে উদ্দেশ্য করে গঠিত মন্ত্র। এটি আত্মবিশ্বাস, ধর্মনীতি ও ঈশ্বরভাবনার মূর্ত প্রতিফলন।
2. যজুর্বেদ :-- যজ্ঞ ও পূজার বিধান ও আচরণবিধি এখানে বর্ণিত। দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার নিয়ম, বেদমন্ত্রসমূহ কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে উচ্চারণ করতে হবে এসব এখানে বলা হয়েছে।3. সামবেদ :- - এটি মূলত ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহকেই সুরে গাওয়ার উপযোগী করে গঠিত।
- গীতিময় এই বেদ যজ্ঞের পরিবেশে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটায়।
4. অথর্ববেদ):-- এতে দৈনন্দিন জীবন, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পরিবার, রাজনীতি, সমাজনীতি ও আধ্যাত্মিক চিন্তার সমন্বয় রয়েছে।
এটি প্রমাণ করে যে বেদের জ্ঞান কেবল আধ্যাত্মিক নয়, ব্যবহারিক জীবনেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিটি বেদের সঙ্গে একটি উপবেদ যুক্ত-
ঋগ্বেদ: স্থাপত্যবেদ (স্থাপত্যশাস্ত্র)।
যজুর্বেদ: ধনুর্বেদ (যুদ্ধবিদ্যা)।
সামবেদ: গান্ধর্ববেদ (সঙ্গীত ও নৃত্যশাস্ত্র)।
অথর্ববেদ: আয়ুর্বেদ (চিকিৎসাশাস্ত্র)।
খিল অংশ: এগুলো বেদের মূল সংহিতায় অন্তর্ভুক্ত না হলেও, বেদসংহিতার সঙ্গে যুক্ত কিছু অতিরিক্ত সূক্ত বা অংশ, যা সাধারণত মূল চারটি বিভাগের বাইরে।
বেদ অধ্যয়নের জন্য ছয়টি শাস্ত্র অপরিহার্য-
শিক্ষা: উচ্চারণ ও স্বরবিজ্ঞান।
কল্প: যজ্ঞ ও আচার-অনুষ্ঠানের নিয়ম।
ব্যাকরণ: ভাষা ও শব্দের গঠন।
নিরুক্ত: শব্দের ব্যুৎপত্তি ও অর্থ।
ছন্দ: কাব্যের ছন্দ ও মাত্রা।
জ্যোতিষ: সময় ও নক্ষত্রবিদ্যা।
বেদের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব:****
1. বেদ আমাদের আত্মপরিচয় করায় আমরা শরীর নই, আমরা আত্মা।
2. এটি জীবনকে অর্থবহ করে তোলে ধর্ম (নৈতিকতা), অর্থ (সমৃদ্ধি), কাম (ইচ্ছা) ও মোক্ষ (মুক্তি) এই চার পুরুষার্থের মাধ্যমে।
3. বেদের জ্ঞান অনুসরণ করে মন শুদ্ধ হয়, চিত্ত বিশুদ্ধ হয় এবং পরমাত্মার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন হয়।
বেদ অনুসরণ মানে নিজেকে জানার যাত্রা শুরু করা, নিজেকে খুঁজে পাওয়া। এই জ্ঞানই আমাদের সমস্ত অজ্ঞানতা দূর করে।
4. আসুন, আমরা বেদের এই অপার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হই।
আত্মজ্ঞান, ভক্তি ও ধর্মপথে চলি।
"কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি, ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম, নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্॥"---- শ্রীমদ্ভাগবত গীতা (৩.১৫)
অর্থ: সব কর্মই বেদ থেকে নির্গত, আর বেদ উদ্ভূত অক্ষরাত্মা ব্রহ্ম থেকে। এই জন্য, সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত সেই ব্রহ্ম সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত।