শ্রীজগন্নাথের নিত্যপূজা
"গর্ভগৃহে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত শ্রীজগন্নাথদেব, শ্রীবলভদ্রদেব, দেবী সুভদ্রা ও সুদর্শনচক্র এই চতুর্ধা বিগ্রহের নিত্যপূজা ও রীতিনীতি সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করা হলো।"
---"যুগ-যুগব্যাপী কাল অবস্থানকারী তাঁর দিব্য আবির্ভাবের অনুধ্যানে আমাদের জীবন মধুময় হোক, নিজ নিজ দিব্যস্বরূপ আমদের জীবনে বিকশিত হোক এই তাঁর চরণে প্রার্থনা।”-----
.....শ্রীশ্রীঠাকুরের বৈকালিক অনুধ্যানে শ্রদ্ধেয়া মৌমিতা মণ্ডল মহাশয়ার লেখা "শ্রীজগন্নাথের নিত্যপূজা" শীর্ষক প্রবন্ধের বিষয়বস্তুতে কয়েকটি পর্বে মনোনিবেশের চেষ্টা করবো, আজ (২ জুলাই ২০২৫) তার ৩য় তথা শেষ পর্ব......
..... শ্রীশ্রীঠাকুর তুমি কৃপা করে আমাদের চেতনার উন্মেষ ঘটাও এবং আমাদের উপলব্ধি ঋদ্ধ করো এই প্রার্থনা করি.....
শ্রীজগন্নাথের নিত্যপূজা (৩য় তথা শেষ পর্ব)
মধ্যাহ্ন পহড় (দুপুর ১টা ৩০-বিকাল ৪টা) :
মধ্যাহ্ন ধূপের পর দেবতাদের এটি বিশ্রামের সময়। এর আগে দেবতাদের পোশাক পরিবর্তন করা হয়। তারপর চারটি রত্নপালঙ্ক নিয়ে আসেন খাটসেজা মেকাপ সেবায়েতরা; এই পালঙ্কগুলি রত্নসিংহাসনের নিচে সাজানো হয়। এরপর বাদাদুয়ার পধিয়ারি দেবতাদের আমন্ত্রণ জানান --- "মণিমা, মণিমা। অনুগ্রহ করে রত্নসিংহাসন থেকে নেমে এসে রত্নপালঙ্কে বিশ্রাম নিন।" তখন মন্দিরের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুনরায় তা খোলা হয় বিকাল ৪টায়। কার্তিক এবং পৌষ মাসে সন্ধ্যা ৬টায় মন্দির খোলা হয়। কোনো কোনো সময় মধ্যাহ্ন পহড় হয় না। জগন্নাথদেব তাঁর ভক্তদের কৃপা করতে দিনে খুব কম সময়ের জন্য বিশ্রাম নেন; প্রকৃতপক্ষে তিনি সর্বক্ষণ জগতের কল্যাণে তাঁর বৃহৎ চক্ষু অপলক রাখেন, তাই তাঁর অপর নাম 'অনিমিষ'।
সন্ধ্যারতি (সন্ধ্যা ৬টা) :
শ্রীজগন্নাথের সন্ধ্যারতি তালুছা মহাপাত্র এবং শ্রীবলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীর আরতি দুজন পুষ্পালক করেন। সেবায়েতরা দেবতাদের কর্পূর ও একুশটি প্রদীপ দিয়ে সঞ্জকাহালি আরতি করেন। যেদিন মধ্যাহ্নে বিশ্রাম হয়, সেদিন সন্ধ্যারতির পর দেবতাদের পোশাক ও সাজসজ্জার পরিবর্তন করা হয়। সমস্ত একাদশীর দিনে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, কিন্তু যেদিন এই মধ্যাহ্ন পহড় মানা হয় না, সেদিন সন্ধ্যারতির আগে দেবতাদের পোশাক পরিবর্তন করা হয়।
সন্ধ্যা ধূপ (সন্ধ্যা ৬টা ৩০-রাত ৮টা) :
এই সময় দেবতাদের সন্ধ্যার ভোগ অর্পণ করা হয়। মন্দির-প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করে এই ভোগ ষোড়শোপচারে পূজা করে দেওয়া হয়। এই ভোগে দেবতাদের মঠপুলি, ভোগ পিঠা, সুবাস পাখাল, সানা ও বড় কদম্ব ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। এরপর বিশ্বের মঙ্গলের জন্য জয়মঙ্গল আরতি করেন তিনজন পূজাপাণ্ডা। এরপর পুনরায় সাহানমেলা হয়।
মৈলম ও চন্দনলাগি (রাত ৯টা-১০টা) :
সন্ধ্যা ধূপের পর দেবতাদের আবার পোশাক পরিবর্তন হয়, তাঁদের সাজানো হয় বড়শৃঙ্গার বেশে। রাতের পোশাক পরানোর পূর্বে কস্তুরী ও কর্পূরের সাথে চন্দন মিশিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়,
একে 'চন্দনলাগি' বলে। বড়শৃঙ্গার বেশে দেবতাদের ওড়িশার তাঁতশিল্পীদের তৈরি এক বিশেষ রকমের রেশমি পোশাক পরানো হয়। এর ওপর রঞ্জক পদার্থ দিয়ে জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ'-এর কিছু শ্লোক লেখা থাকে। নানান সুগন্ধি ফুল দিয়ে দেবতাদের এই সময় সাজানো হয়। দেবতাদের সামনে 'গীতগোবিন্দ' গাওয়া হয়।
বড়শৃঙ্গার ধূপ (রাত ১০টা ৩০) :
বড়শৃঙ্গার বেশের পর দিনের শেষ ভোগ 'বড়শৃঙ্গার ধূপ' নিবেদন করা হয়। রত্নসিংহাসনের নিচে তিন পূজাপাণ্ডা পঞ্চোপচারে পূজা করে দেবতাদের উদ্দেশে নিবেদন করেন খাঁটি ঘি, কদলি বড়া, খিরি, সাকারা, পিঠা ও কাঞ্জি।
খাটসেজালাগি (রাত ১১টা ৩০) :
এটি দেবতাদের ঘুমানোর আগের রীতি। ভাণ্ডারঘর থেকে শয়ন ঠাকুর, সোনার তৈরি লক্ষ্মী ও নারায়ণের যৌথ মূর্তি নিয়ে এসে শ্রীবিগ্রহের পাশে স্থাপন করা হয়। রত্নসিংহাসনের নিচে রত্নপালঙ্ক সাজানো হয় শয়নের জন্য। এই সময় দেবতাদের ডাবের জল এবং পান নিবেদন করা হয়। রত্নসিংহাসনের নিচে দাঁড়িয়ে প্রতিমহাপাত্র (যিনি প্রধান সেবক ও শ্রীমন্দিরে জগন্নাথদেবের পিতাস্বরূপ) ও পুষ্পালকরা কর্পূর জ্বালিয়ে দেবতাদের শয়নারতি করেন। এরপর মন্দিরের সকল দরজা বন্ধ করেন তালুছা মহাপাত্র।
নির্দিষ্ট উৎসবের দিনে অতিরিক্ত আচার-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। ফলস্বরূপ সময়ের পরিবর্তন এবং নিয়মিত আচার-অনুষ্ঠানের পরিবর্তন হয়।