চন্দ্রদেব
চন্দ্রদেব শাস্ত্রীয় দিক থেকে ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ দেবতা, যিনি চাঁদের দেবতা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে "মন" বা মানসিক অবস্থার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তিনি কেবল আকাশের এক উজ্জ্বল গ্রহই নন, বরং নানা পৌরাণিক, ধর্মীয় ও জ্যোতিষশাস্ত্রীয় দিক থেকে অসাধারণ গুরুত্ব বহন করেন।
পরিচয় :----
নাম: চন্দ্র, সোম, শশধর, নিশানাথ, ইন্দু, হিমাংশু ইত্যাদি নামে পরিচিত।
চন্দ্র দেবের চিত্রবর্ণনা:---রুপালী কান্তি-মাথায় মুকুট-হাতে অস্ত্র চন্দ্ররথে বসে, আকাশে গমনরত।
পিতা: ঋষি অত্রী
মাতা: অনসূয়া
গোত্র: আত্রেয়
বংশ: সোম বংশ (যা থেকে বহু রাজাদের বংশ চলেছে, যেমন চন্দ্রবংশ)
স্ত্রীগণ: দক্ষ প্রজাপতির ২৭ কন্যা (নক্ষত্র), মূলত রোহিণী ছিল তার প্রিয়তমা
যেমন: অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্য, আশ্লেষা ইত্যাদি।
বাহন: রথ
পৌরাণিক কাহিনি ও তাৎপর্য:********
1. দক্ষের অভিশাপ ও চন্দ্রক্ষয়
চন্দ্র দেব দক্ষ প্রজাপতির ২৭ কন্যাকে বিবাহ করেন, কিন্তু শুধু রোহিণীকেই ভালোবাসতেন। বাকি স্ত্রীরা অভিযোগ করলে, দক্ষ চন্দ্রকে অভিশাপ দেন—তিনি দিন দিন ক্ষয়প্রাপ্ত হবেন। পরে মহাদেব (শিব) এই অভিশাপ কিছুটা শিথিল করেন, ফলে চন্দ্র দেব "কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ" – অর্থাৎ হ্রাস ও বৃদ্ধি – এই চক্রে ঘুরতে থাকেন।
2. চন্দ্র ও শিবের সম্পর্ক
চন্দ্র অভিশপ্ত হয়ে যখন ক্ষয় হতে থাকে, তখন তিনি ভগবান শিবের আশ্রয় নেন। শিব তখন তাঁকে নিজের জটায় ধারণ করেন। তাই শিবের আরেক নাম "চন্দ্রশেখর"।
3. সোমযজ্ঞ ও অমৃত
সমুদ্র মন্থনের সময় চন্দ্র দেব সমুদ্র থেকে উঠে আসেন। তাঁকে দেবতারা গ্রহণ করেন এবং তিনি অমৃত পান করেন। তাই চন্দ্রকে অমরত্বের প্রতীকও ধরা হয়।
মানসিক ও জ্যোতিষশাস্ত্রীয় গুরুত্ব***********
জ্যোতিষশাস্ত্রে চন্দ্র গ্রহের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:*********
1. মন ও আবেগ: চন্দ্র মানসিক অবস্থা, স্মৃতি, কল্পনা ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে।
2. মা ও মাতৃত্ব: চন্দ্র মায়ের প্রতীক। মাতৃভাব, সংবেদনশীলতা ও স্নেহ জাগায়।
3. রাশিচক্রে স্থান: কর্কট রাশির অধিপতি। তার উচ্চস্থান বৃষে এবং নিঃশেষ হয় বৃশ্চিকে।
4. চন্দ্র লগ্ন: অনেক ক্ষেত্রে জন্মকুণ্ডলীর বিশ্লেষণ চন্দ্র লগ্ন ধরে করা হয়।
5. চন্দ্রমাস: চাঁদের গতি অনুযায়ী হিন্দু ক্যালেন্ডারের মাস ও তিথি নির্ধারণ হয়।
পূজা ও উপাসনা:****
চন্দ্র পূজা করা হয় মানসিক প্রশান্তি, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য।
সোমবার চন্দ্র দেবের বার।
উপবাস: সোমব্রত পালন করলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস।
আধুনিক দৃষ্টিকোণ:--আধুনিক মানসিক স্বাস্থ্য চর্চাতেও চন্দ্রের প্রভাব প্রাসঙ্গিক। মানসিক শান্তি, মানসিক রোগ, আবেগগত ওঠানামা—এসব বিষয়ে চন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয়।
উপসংহার:---চন্দ্র দেব শুধুই রাতের আকাশের সৌন্দর্য নয়; তিনি জীবনচক্র, মানসিকতা, সময় এবং ভাগ্যের গভীর প্রতীক। তিনি প্রেম, সৌন্দর্য, কল্পনা ও স্মৃতির দেবতা হিসেবেও পূজিত। হিন্দুধর্মে চন্দ্র দেব এক অনন্য দ্যুতি ও রহস্যময় শক্তির প্রতীক।