দেবর্ষী নারদের জন্ম
গন্ধর্ব উপবর্হণ ও অভিশাপ
অনেক অনেক কাল আগের কথা। পূর্বের এক কল্পে নারদ মুনি ছিলেন 'উপবর্হণ' নামের এক সুঠাম ও রূপবান গন্ধর্ব। গন্ধর্ব হওয়ার কারণে তিনি গান-বাজনায় পারদর্শী ছিলেন এবং দেখতে অত্যন্ত সুন্দর ছিলেন। কিন্তু তাঁর মনে অহংকার ছিল এবং তিনি সবসময় নারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আমোদ-প্রমোদে মত্ত থাকতেন।
একবার প্রজাপতিরা এবং দেবতারা মিলে এক বিশাল 'সঙ্কীর্তন' ও যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেখানে ভগবানের গুণগান গাওয়ার জন্য গন্ধর্বদের আমন্ত্রণ জানানো হলো। উপবর্হণ সেখানে গেলেন, কিন্তু ভক্তিভরে গান গাওয়ার বদলে তিনি নারীদের সাথে হাস্যরস ও চপলতা করতে শুরু করলেন।
এই ধৃষ্টতা দেখে প্রজাপতিরা ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁরা তাকে অভিশাপ দিলেন, "তুমি ভগবানের পবিত্র নাম ও ভক্তদের অপমান করেছ। তাই তুমি স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে মর্ত্যলোকে 'শূদ্র' বা নিচু কুলে জন্মগ্রহণ করবে।
দাসীপুত্র রূপে জন্ম ও ভক্তি লাভ
অভিশাপের ফলে উপবর্হণ মর্ত্যলোকে এক অতি দরিদ্র দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন। তাঁর মা ছিলেন এক সামান্য সেবিকা, যিনি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের আশ্রমে কাজ করতেন। ছোট্ট বালকটি (নারদ) মায়ের সাথেই আশ্রমে থাকতেন।
ঋষিদের সেবা ও উচ্ছিষ্ট ভোজন
একবার বর্ষাকালে 'চাতুর্মাস্য' ব্রত পালন করার জন্য কয়েকজন মহান ঋষি বা ভক্তিবাদী সাধু সেই আশ্রমে চার মাসের জন্য অবস্থান করলেন। ছোট্ট নারদ ছিলেন অত্যন্ত শান্ত ও বাধ্য। তিনি কায়মনোবাক্যে সেই ঋষিদের সেবা করতেন।
ঋষিরা তাঁর সেবায় অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। একদিন নারদ ঋষিদের অনুমতি নিয়ে তাঁদের ভোজনের পাত্রে অবশিষ্ট খাবার (উচ্ছিষ্ট প্রসাদ) গ্রহণ করলেন।
মহাত্মাদের সেই প্রসাদ খাওয়ার ফলে নারদের হৃদয়ের সমস্ত পাপ ধুয়ে গেল এবং তাঁর মনে ভগবানের প্রতি প্রবল ভক্তির উদয় হলো। ঋষিরা যাওয়ার সময় তাকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান দান করলেন।
মায়ের মৃত্যু ও গৃহত্যাগ
ঋষিরা চলে যাওয়ার পর নারদ তাঁর মায়ের সাথে থাকতে লাগলেন। তিনি তখন মাত্র পাঁচ বছরের শিশু। তাঁর মা-ই ছিলেন তাঁর একমাত্র বন্ধন। একদিন রাতে তাঁর মা গরুর দুধ দোয়ানোর জন্য গোয়ালঘরে গেলে, তাঁর পায়ে এক বিষধর সাপ দংশন করে। বিষের প্রভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সাধারণ শিশুর মতো কান্না না করে, জ্ঞানলব্ধ নারদ একে ভগবানের আশীর্বাদ হিসেবেই দেখলেন। তিনি ভাবলেন, "ভগবান হয়তো আমার মায়ার শেষ বাঁধনটুকুও কেটে দিলেন যাতে আমি পুরোপুরি তাঁর চরণে মন দিতে পারি।"
অনাথ শিশু নারদ তখন উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। চলতে চলতে তিনি এক গভীর ও নির্জন বনে উপস্থিত হলেন। সেখানে এক বটগাছের নিচে বসে তিনি ঋষিদের শেখানো পদ্ধতিতে ভগবানের ধ্যানে মগ্ন হলেন।
ভগবানের দর্শন ও দৈববাণী
ধ্যান করতে করতে নারদের চোখে জল চলে এল। হঠাৎ তাঁর হৃদয়ে এক দিব্য জ্যোতির প্রকাশ হলো এবং তিনি ভগবান বিষ্ণুর এক ঝলক দর্শন পেলেন। সেই আনন্দ ছিল অবর্ণনীয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই সেই রূপ মিলিয়ে গেল।
নারদ ব্যাকুল হয়ে আবার সেই রূপ দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তখন আকাশ থেকে এক দৈববাণী শোনা গেল:
"হে বৎস, এই জন্মে তুমি আর আমাকে দেখতে পাবে না। আমি একবার তোমাকে দর্শন দিলাম যাতে তোমার মনে আমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়। তুমি এখন অপূর্ণ যোগী। যখন তোমার দেহাবসান হবে এবং নতুন সৃষ্টি শুরু হবে, তখন তুমি আমার পার্ষদ বা নিত্যসঙ্গী হিসেবে জন্মগ্রহণ করবে।"
ব্রহ্মার মানসপুত্র রূপে নারদের আবির্ভাব
এরপর নারদ সারা জীবন ভগবানের নাম গান করে কাটালেন। একসময় সেই কল্পের শেষ হলো। প্রলয়কাল উপস্থিত হলে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে গেল এবং সবকিছু ভগবান বিষ্ণুর শরীরের ভেতরে লীন হয়ে গেল। নারদও ব্রহ্মার নিশ্বাসের সাথে ভগবানের শরীরে প্রবেশ করলেন।
হাজার যুগ পার হওয়ার পর, আবার যখন নতুন সৃষ্টি শুরু হলো, তখন ব্রহ্মা পদ্মফুলের ওপর জেগে উঠলেন। ব্রহ্মা যখন সৃষ্টি রচনা শুরু করলেন, তখন তাঁর কোলের ওপর থেকে (মতান্তরে উরু বা মন থেকে) এক দিব্য ঋষির আবির্ভাব হলো। ইনিই হলেন আমাদের পরিচিত দেবর্ষী নারদ।
এবার আর তিনি সাধারণ মানুষ নন। ভগবান বিষ্ণু তাকে একটি বিশেষ বীণা দান করলেন, যার নাম 'মহতী'। ভগবান বর দিলেন যে, নারদ ত্রিভুবনের যেকোনো স্থানে যখন খুশি যেতে পারবেন এবং সবসময় 'নারায়ণ নারায়ণ' নাম গান করে জীবকে উদ্ধার করবেন।
এভাবেই এক সাধারণ দাসীপুত্র তাঁর সেবা, ভক্তি ও ত্যাগের মাধ্যমে ত্রিভুবন খ্যাত দেবর্ষী নারদে পরিণত হলেন।