চিরঞ্জীবী বিভীষণ
বিভীষণ ছিলের সাত্ত্বিকগুণ সম্পন্ন ও শুদ্ধসাত্ত্বিক হৃদয়বান পুরুষ৷ ছোটোবেলা থেকে তিনি প্রায় সময়েই ঈশ্বর সাধনা ও দেবতার ধ্যান করতে পছন্দ করতেন৷ ঘটনাক্রমে ব্রহ্মা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বরদান করতে চাইলে বিভীষণ দেবতার চরণকমলে নিজের মনোনিবেশ করতে পারার শক্তি চান৷ এবং এই একাগ্র মনঃসংযোগের দ্বারাই তিনি তিনি শ্রীবিষ্ণুর দর্শন চান ও তার চরণস্পর্শ করতে চান বলে বর চান৷ তার এই ইচ্ছা খুব ভালোভাবেই পূর্ণ হয় এবং রামায়ণ মতে বিভীষণ তার সুখ ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবন ছেড়ে বিষ্ণুর অবতার শ্রীরামের সাথে সাক্ষাৎকার করেন এবং দুরাচারী হত্যায় তাকে যথাসাধ্য সাহায্য ও সেবা করেন৷
বিভীষণ ছিলেন ঋষি বিশ্রবা ও নিকষার কনিষ্ঠ পুত্র৷ পুলস্ত্য মুনির উত্তরসূরী পৌলস্ত্য হিসাবে তিনি যোগ্য সাত্ত্বিকগুণের সম্পন্ন ছিলেন৷ তিনি লঙ্কার রাজা রাবণ ও নিদ্রার রাজা কুম্ভকর্ণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, তথা ধনদেবতা কুবের ছিলেন তার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা৷ রক্ষকুলে রাক্ষসী মায়ের কোলে জন্ম হলেও তিনি তার পিতার মতো সতর্ক এবং ধার্মিক ছিলেন এবং নিজেকে ব্রাহ্মণ হিসাবেই নিজেকে গড়ে তোলেন৷শৈশব থেকেই বিভীষণের মন পবিত্র এবং সাত্ত্বিক স্বভাব ছিল। জন্মগতভাবে তিনি একজন রাক্ষস হলেও, তিনি নিজেকে একজন ব্রাহ্মণ বলে মনে করতেন। তিনি সপ্ত চিরঞ্জীবী বা হিন্দুধর্মের সপ্ত অমর সত্তার একজন, যারা বর্তমান কলিযুগের শেষ অবধি বেঁচে থাকবেন।
তিনি ছিলেন একজন মহৎ চরিত্রের অধিকারী এবং শ্রী মহাবিষ্ণুর সপ্তম অবতার এবং রামায়ণের কেন্দ্রীয় চরিত্র ভগবান রামের একজন মহান ভক্ত । বিভীষণ শান্তির পক্ষে ছিলেন এবং রাবণকে রামের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ না করার পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার ভাই সীতাকে তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিক।
জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাবণের থেকে বিপরীতগুণ সম্পন্ন হওয়ার কারণে তিনি রাবণের দ্বারা সীতাহরণের ঘটনা মেনে নিতে পারেননি৷ উপরন্তু তিনি রাবণকে এবিষয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলে রাবণ তাকে অপমান করেন৷ ফলে তিনি মা নিকষার পরামর্শে লঙ্কা ত্যাগ করেন৷ পরে তিনি রামের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সৈন্যগঠনে সাহায্য করে সীতা পুণরুদ্ধারের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন৷ তিনি রামসনার কাছে রাবণের প্রতিরক্ষাবাহিনীর গুপ্ত তথ্য ফাঁস করেন ও রামকে এই ধর্মযুদ্ধ জয়ের আশ্বাস দেন৷ রাম বিভীষণের কথা মেনে নেন এবং রাবণ-বধের পর তাকে লঙ্কার সিংহাসনে বসানোর প্রতিশ্রুতি দেন৷
লঙ্কার রাম-রাবণের যুদ্ধে লঙ্কার গুপ্ত তথ্যের বিষয়ে বিভীষণের জ্ঞান রামের যুদ্ধ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে৷ বিভীষণ নিঃসঙ্কোচে লঙ্কাপুরীর অনেক অন্তরালের তথ্য বিষয় রামের সামনে উন্মোচন করেছিলেন যেমন পৌলস্ত্য কুলমাতা নিকুম্ভিলা মন্দির ও যজ্ঞাগারের গুপ্ত রহস্য ফাঁস রামের যুদ্ধজয়ে অন্যতম কারণ ছিলো৷ রাম ও রাবণের মেঘের অন্তরালে যুদ্ধ চলাকালীন রাম রাবণকে চিহ্নিত করতে অক্ষম হয়ে পড়লে তিনিই রাবণের মৃত্যুর পথ তাকে জ্ঞাত করান৷ তিনি রামকে জানান যে রাবণ তার উদরে সঞ্চিত করে রেখেছেন, ফলে সেই সুগন্ধীকে শুষ্ক করা অত্যাবশ্যক৷ অন্তিমে রাম রাবণকে বধ করতে সক্ষম হন৷ আবার আধুনিক পাঠকবর্গ ভারতীয় মহাকাব্যগুলির সুচরিত্র ও দূরাচারী বিশ্লেষণ করার সময়ে রামায়ণে চিত্রায়িত চরিত্রগুলির বিশ্লেষণে ধর্ম বিষয়ক দ্যোতক অর্থ খুঁজে পান৷ মহাকাব্যটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে কুম্ভকর্ণ বা বিভীষণ কেউই ধর্মের পথ ছেড়ে স্বেচ্ছায় অধর্ম করতে চাননি কিন্তু তাদের কাছে উভয়সঙ্কট নিষ্পত্তির দ্বিতীয় কোনো পথ না থাকায় তারা নিজেদের ধর্মমতো পক্ষ চয়ন করেন৷ রামায়ণ শিক্ষা দেয় যে, কুম্ভকর্ণ তার রাবণকে পরামর্শ দেওয়ার পর সে তা মানতে অপ্রস্তুত থাকলে তিনি(কুম্ভকর্ণ) ভ্রাতার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তার পক্ষ নেয়, আবার বিভীষণের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটলে তিনি(বিভীষণ) তার বিরোধ করেন৷
প্রতীকীভাবে, রামায়ণে বিভীষণ চরিত্রটি ছিলো শ্রীরামের প্রতি আত্মসমর্পণকৃত তার এক ভক্তের৷ চরিত্রটি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ঈশ্বর তার ভক্তের কুল গোত্র বা জন্মস্থান দেখে ভেদাভেদ করেন না৷ একই ধরনের নীতিকথা প্রহ্লাদ ও নরসিংহের শ্রুতিতেও লক্ষ্য করা যায়৷
রাবণ-বধের পর বিভীষণ লঙ্কার সিংহাসনে বসলে তিনি সম্পূর্ণভাবে দৈত্যসুলভ আচরণ এবং দৈত্যরীতি বিসর্জন দেন এবং সঠিক ধর্মের পথে চলা শুরু করেন৷ তার স্ত্রী ও লঙ্কার রাণী সরমা তাকে ধর্মের পথে চলতে সহধর্মিণীর ভূমিকা পালন করে৷ পরবর্তীকালে ত্রিজটা নাম্নী এক কন্যাসন্তান জন্মায়৷
যুদ্ধ শেষে রাম যখন অযোধ্যার দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন, ঠিক তখনই তিনি নিজের আসল বিষ্ণুরূপে বিভীষণকে দর্শন দেন এবং পৃৃথিবীতে থেকে মানবসেবা করে তাদের সঠিক ধর্মপথের দিশা দেওয়ার দেশ করেন৷ এভাবে বিভীষণ দীর্ঘ অমরত্ব পান ও সপ্ত চিরঞ্জীবিদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন৷ বিষ্ণুরূপে তিনি বিভীষণকে রামের জন্মগত সূর্যবংশের দেবতা শ্রীরঙ্গনাথের আরাধনা করতে বলেন৷
ইতিহাসের বেশ কিছু পর্বে সিংহলিরা বিভীষণকে তাদের চারজন অভিভাবক (চতুর্মহারাজা) ও রক্ষাকর্তার মধ্যে একজন বলে গণ্য করে থাকেন৷ বিভীষণ এই খবর চরদের দ্বারা সিংহলী পার্বত্য ময়নার পায়ে বাঁধা চিঠির মাধ্যমে কেলণিয় তে পাঠানোর আদেশ দেন ৷ খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে তিনি পত্তিনি দেবীর দ্বারা দেবত্ব লাভ করেন ৷ ঐসময়ে তিনি কেলণিয় অঞ্চলে অগণিত ভক্তের দ্বারা পূজিত হতে থাকেন৷
প্রশ্ন: বিভীষণের মা কে ছিলেন?
উত্তর: কৈকসী (নিকাশ, মালিনী, সুকেশী ): ঋষি বিশ্রবের স্ত্রী এবং রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ এবং শূর্পণখার মা। তিনি রাক্ষস রাজা সুমালির স্ত্রী কেতুমতি/কেতুমালির কন্যা ছিলেন।
প্রশ্ন: বিভীষণের স্ত্রী নাম কি ছিল?
উত্তর: সরমাকে বিভীষণের স্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়
প্রশ্ন: বিভীষণের কন্যার নাম কি?
উত্তর : ত্রিজটাকে তার কন্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রশ্ন: বিভীষণের পুত্রের নাম কী ছিল?
উত্তর : তরুণী সেন
প্রশ্ন: বিভীষণ কি মন্দোদরীকে বিয়ে করেছিলেন?
উত্তর : বিভীষণের সাথে পুনর্বিবাহ ---মন্দোদরী এবং বিভীষণের মধ্যে বিবাহ তাদের "পারস্পরিক যৌন হস্তক্ষেপের" উপর ভিত্তি করে বিবাহ নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে "রাষ্ট্রনায়কের কাজ"।
প্রশ্ন: বিভীষণ কি কৃষ্ণের সাথে দেখা করেছিলেন?
উত্তর : চিরঞ্জীবী বিভীষণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুরোধ নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে দেখা করেছিলেন ।
হ্যাঁ, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় বিভীষণের সাথে যুধিষ্ঠিরের দেখা হয়েছিল। রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনীর প্রেক্ষাপট দুটি ভিন্ন যুগে হলেও, এই দুই মহাকাব্যের কিছু চরিত্র একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময়, সহদেব দক্ষিণ ভারতে অভিযানকালে লঙ্কার রাজা বিভীষণের সাথে দেখা করেন।
বিভীষণ পত্তিনি দেবীর দ্বারা দেবত্ব লাভ করেন। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, তিনি কেলানিয়া অঞ্চলে পত্তিনি দেবীর পূজা লাভ করেন এবং দেবত্ব প্রাপ্ত হন। বিভীষণের এই দেবত্ব লাভের ঘটনাটি কেলানিয়া অঞ্চলের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পত্তিনি দেবী: পত্তিনি দেবী শ্রীলঙ্কার একজন জনপ্রিয় দেবী, যিনি শুদ্ধতা, সতীত্ব এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিত হন।
কেলানিয়া: কেলানিয়া শ্রীলঙ্কার একটি ঐতিহাসিক স্থান, যেখানে বিভীষণের মন্দির অবস্থিত।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ষষ্ঠদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, কেলানিয়া অঞ্চলে বিভীষণের পূজা জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এই সময়েই তিনি পত্তিনি দেবীর আশীর্বাদে দেবত্ব লাভ করেন বলে মনে করা হয়।
কিছু বিশ্বাস অনুযায়ী, বিভীষণ আজও লঙ্কার এক রহস্যময় স্থানে রাজত্ব করছেন এবং মানবজাতির মঙ্গলের জন্য কাজ করছেন। তিনি পত্তিনি দেবীর কৃপায় দেবত্ব লাভ করেন এবং পরবর্তীতে একজন দেবতা হিসেবে পূজিত হন। বিভীষণের দেবত্ব লাভের বিষয়টি শ্রীলঙ্কার লোককথায় ও সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে প্রচলিত।
বিভীষণ জগন্নাথের একজন ভক্ত এবং তিনি নিয়মিত মন্দিরে পূজা করতেন ---বিভীষণের নিয়মিত পূজা করার ধারণাটি কিংবদন্তি এবং লোককথার মধ্যে সীমাবদ্ধ।