সনাতন পঞ্জিকায় মলমাস একটি অতি পরিচিত নাম। মলমাস মানেই সেই মাসে পূজাপার্বণদি ও সবধরনের শুভানুষ্ঠান বন্ধ থাকে। মলমাসের কারণে কখনও কখনও দুর্গাপূজা মহালয়ার একমাস পরে কার্তিক মাসে চলে যায়। কিন্তু এই মলমাস কী? এর হিসাব কেন আবশ্যক? এটি কি পুরোপুরি একটি কুসংস্কার মাত্র!
আমাদের প্রায় সব সনাতন ধর্মীয় উৎসব পালন হয় সৌর ও চান্দ্র মাসের সমন্বয়ে নির্ধারিত দিনে। কারণ সঞ্চারণশীল এই পৃথিবী সূর্য ও চন্দ্র উভয়ের দ্বারাই প্রভাবিত। সনাতন রীতিতে পূজাপার্বণ হয় তিথি অনুযায়ী, তিথি নির্ণয় হয় পৃথিবীর সাপেক্ষে চন্দ্রের অবস্থানের ভিত্তিতে। অন্যদিকে একেক পূজার তিথি নির্ণয় হয় মাস তথা ঋতু অনুসারে। এই ঋতু নির্ভর করে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের অবস্থানের ওপর। যেমন ধরুন আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজার জন্য নির্ধারিত সময় হলো শরৎকালের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথি থেকে দশমী। অর্থাৎ সনাতন রীতিতে ধর্মীয় উৎসবে সৌর বর্ষের ও চান্দ্রবর্ষের উভয় হিসাব নিকাশ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

চন্দ্র-সূর্যের হিসেব-নিকেশঃ
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে প্রায় ৩৬৫ দিনে, এইজন্য এক সৌরবর্ষের সময়কাল হলো ৩৬৫ দিন। অন্যদিকে চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে সময় লাগায় ২৯.৫ দিন। সুতরাং, ১২ বার ঘুরতে সময় লাগায় (২৯.৫ x ১২) = ৩৫৪ দিন।অতএব, এক চান্দ্র বর্ষের সময়কাল হলো ৩৫৪ দিন। এখানেই লুকিয়ে রয়েছে সেই সমস্যা। একটি চান্দ্র বর্ষের সময়কাল একটি সৌর বর্ষের সময়কালের থেকে (৩৬৫-৩৫৪) = ১১ দিন কম। ৩৬০ টি তিথি সম্পূর্ণ হয় ৩৫৪ দিনে। আর একটি সৌর বর্ষের সময়কাল হলো ৩৬৫ দিন। অর্থাৎ প্রতি বছর সৌর বর্ষের সমাপ্তি ঘটার আগেই চান্দ্র বর্ষের সমাপ্তি হয়ে নতুন চান্দ্র বর্ষের এগারো দিন সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। এতে করে পুজো পার্বণ গুলি গত বছরের থেকে দশ বা এগারো দিন করে এগিয়ে যায়। এই হিসাবে প্রতি ২ বা ৩ বছর অন্তর চান্দ্র মাস সৌর মাসের থেকে ২০ থেকে ৩০ দিন সময় এগিয়ে যায়। এমনিভাবে চলতে থাকলে পূজাপার্বণ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যেতে থাকবে এবং তা নির্দিষ্ট ঋতুতে আর সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে না। একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে এবং নির্দিষ্ট তিথিতে পূজাপার্বণদি করার জন্য সৌর বর্ষ আর চান্দ্রবর্ষের সমন্বয় করার একান্ত জরুরি। নাহলে হয় তিথি ঠিক থাকবে, ঋতু বদলে যাবে কিংবা তার উল্টো। এই সমস্যাটিকে সমন্বয় করার জন্য প্রতি দুই বা তিন বছর অন্তর সৌর বর্ষের তুলনায় অতিরিক্ত চান্দ্র মাসটিকে "অধিমাস" ধরে ওই মাসে পূজাপার্বণ স্থগিত রাখা হয়। এই অতিরিক্ত মাসটিতে কোনো পূজাপার্বণাদি ও শুভানুষ্ঠান হয় না বলে ওই মাসটিকে দূষিত মাস বা মল মাস বলে।
অর্থাৎ সনাতন পঞ্জিকায় মলমাসের যে প্রচলন তা কুসংস্কার ত নয়ই বরং প্রাচীন ঋষিদের জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় নিখুঁত গাণিতিক সমাধানের প্রতিফলন।
[ বিঃদ্রঃ যে চান্দ্র মাসে সূর্য রাশি পরিবর্তন করে এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন করে না, তাকেই অধিমাস হিসেবে ধরা হয়। অধিমাসে দুটো অমাবস্যা বা তিনটি প্রতিপদ তিথি থাকতে পারে। ]
তথাকথিত আধুনিকমনা সনাতনী সমাজের মধ্যে একটি ভয়ংকর প্রবণতা রয়েছে যে, যেকোনো সনাতনী সংস্কার বা আচারকে কোন বিচার-বিবেচনা না করেই হুট করে কুসংস্কার দাবী করে আধুনিকমনস্ক নামক একটা মিথ্যা খোলসের ভেতর ঢুকে যাওয়া। তাদের উদ্দেশ্যে স্পষ্টভাবে বলতে চাই; যেকোনো আচার সংস্কারকে কুসংস্কার বলার আগে অন্তত একবার বিচার-বিশ্লেষণ করে নিবেন, নিজেদের পূর্ব পুরুষদের অজ্ঞ ভাবার আগে নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিবেন।
এক মাসে দুটা পূর্ণিমা হলে সেই মাস কে শুদ্ধ মাস বলা হবে, প্রতি দুই বৎসর অন্তর এই কাল উৎপন্ন হয়।