স্বামী নিগমানন্দ পরমহংসদেব নির্দেশ
"গুরুর মরণ নেই–গুরু সাক্ষী, চেতা, কেবল এবং নির্গুণ। সুতরাং গুরুর চোখে কোন সময় তোমরা ধূলি নিক্ষেপ করতে পারবে না। গুরু শিষ্যের প্রতি সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেন। গুরু স্থূল-দেহধারী হলেও অন্তর্যামী—এই কথাটি তোমরা কোন সময় ভুলে যেও না। আমার আদেশ- উপদেশের অবমাননা করলে, আমারই অবমাননা করা হয়। গুরুর প্রতি অবজ্ঞা করলে পরম দয়াল গুরু শিষ্যকে ক্ষমা করতে পারেন, কিন্তু জগদ্গুরুর হাত হতে কারো পরিত্রাণ নেই। তিনি পদমর্যাদা রক্ষার দরুন নির্দয় ভাবে শাসনদণ্ড
পরিচালনা করেন। স্থুলভাবে আমাকে ফাঁকি দিতে পার, কিন্তু আমার ভিতর ফলদাতা, অন্তর্যামীরূপে যিনি বিরাজিত আছেন, তাকে তোমরা কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারবে না। আমি স্থূলদেহ ছাড়লেই আর কিছু দেখতে পাব না, এরূপ ধারণা যাদের, তারা গুরুকেও নিজেদের মত অজ্ঞানী বলে ভাবে। যদি গুরু সম্বদ্ধে কারো এইরূপ ধারণা হয়ে থাকে, তাহলে আমি প্রত্যক্ষভাবে তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা তোমাদের সেই ভ্রান্ত ধারণা অন্তর হতে বিলুপ্ত কর।” শ্রীমৎ স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী পরমহংসদেব।
বীর্য্যক্ষয় হইলে ভাব - ভক্তি সমস্ত বিনষ্ট হইয়া যায়। স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী পরমহংসদেব। সাত্ত্বিক আহারের অশেষ গুণ—পৌরাণিক যুগে তাহার যথেষ্ট দৃষ্টান্ত আছে৷ আতপ তণ্ডুল ও কাঁচাকলা খাইয়াই জ্ঞানগরিষ্ঠ ঋষিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠ, ব্যাস, পতঞ্জলি, জৈমিনি প্রভৃতি মহাত্মারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানালোকে ভারতবর্ষ— আলোকিত করিয়াছিলেন।তাহা হইলে ইহাই প্রমানিত হয় আতপ চাল এবং কাঁচা কলা খাইয়া ব্রহ্মচর্য্যের দ্বারা অচিন্ত্যনীয় জায়গায় পৌঁছেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষগনের অনেকেই। আর আমরা ডিম্ব, মৎস্য, মাংস সর্বভুক প্রানী শিষ্যগন কতটা নীচে অবস্থান করিতেছি একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায়। চৌদ্দ বৎসর ব্রহ্মচর্য পালন করিয়াই রামানুজ লক্ষ্মণ ইন্দ্ৰজিতের বধসাধনে সক্ষম হইয়াছিলেন। একবিংশতিবার ক্ষত্রিয়-হননকারী পরশুরামের অমিতবিক্রম কুমার ব্রহ্মচারী ভীষ্মের নিকট অবনত হইয়াছিল। এরপরে বেশিদিনের কথা নয় , বর্তমান যুগের প্রফেসার রামমূর্ত্তির অলৌকিক পরাক্রমের কথা কাহারও অবিদিত নাই। এবং তাহাও ব্রহ্মচর্যের ফল। শ্রীযুক্ত তিলক, গোখেলের ন্যায় কয়টী বাঙ্গালীর মাথা পরিষ্কার ?
তাই ঠাকুর মহারাজ লিখিলেন যে, ইউনিভার্সিটী হইতে আজকালকার জীবগণ প্রায় চক্ষু , কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ইত্যাদি শূন্য হইয়া বাহির হইতেছে। পুরুষের ধাতুদৌর্বল্য-প্রমেহ আর নারীর বাধক-প্রদর নাই, এমন বাঙ্গালী স্ত্রী-পুরষ কয়জন আছে জানি না ।
শ্রী শ্রী ঠাকুর মহারাজ এরপর ব্রহ্মচর্য্যসাধনের সহায়ক কিছু সাধারণ আসন , কিছু সাধারণ প্রাণায়াম, কিছু সাধারণ মুদ্রা কৈশোর থেকে গৃহী, গৃহিণী সকলের জন্য প্রতিপালনের আদেশ দিলেন। তিনি লিখেছেন যে আসন, প্রাণায়াম ও মুদ্রাসাধন দ্বারা কি উপকার হয়, তাহা কিছুদিন অভ্যাস করিলেই বুঝিতে পারিবে। কারণ এইগুলি পুরো বিজ্ঞানের উপরে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রমাণিত। তিনি লিখিলেন যে এতে ব্রহ্মচর্য্য রক্ষার সহিত অনেক দুঃসাধ্য রোগ থেকেও মুক্তি পাইবে। আমার " যোগীগুরু " পুস্তকে বিস্তারিত প্রমাণ দিয়াছি। আসনগুলি খুবই সহজ, পদ্মাসন, সিদ্ধাসন, পশ্চিমোত্তাসন এবং সিংহাসন। প্রথমে এক দুই মিনিট করিবে, পরে সময় বাড়াইবে, গৃহী এবং গৃহিনীগনের যেটা সুবিধা হয় একটি, দুটি করিলেও সুফল মিলিবে। সুফল হয়েছে কি না তার লক্ষন,
ততো দ্বন্দ্বোহনভিঘাতঃ।—পাতঞ্জল-দর্শন
অর্থাৎ শীত, গ্ৰীষ্ম প্রভৃতি দ্বারা অভিভূত হইতে হয় না। ব্রহ্মচর্য্য পালনের বিশেষ সহায়ক।
প্রাণায়ামে রেচক,পূরক এবং কুম্ভক করিতে হয়। কিন্তু প্রথম প্রথম রেচক এবং পূরক করিবে, তারপর কুম্ভকের দিকে এগোবে।
ইহাতে সুফল পেয়েছো কি না তার লক্ষন মুখে জ্যোতিঃ ফুটিবে এবং কেহ যদি একটু উপরের ধাপে উঠিবার চেষ্টা করে এবং তাতে কৃতকার্য্য হয় তবে তাহাতে সুখের চির বসন্ত
হৃদয় অধিকার করে। এখন এই বিদ্যা দেখাইবার একজনও কেউ লোকালয়ে নেই তাই সহজ প্রাণায়াম প্রথম অভ্যাস করিবে।
পরে উপরের দিকে যাইতে পারিবে। ইচ্ছা থাকিলে শ্রীগুরু যেদিক দিয়ে হোক সহায়তা করিবেন। তৃতীয় মুদ্রা সাধনে লিখিলেন যে মহামুদ্রা,শক্তিচালনী মুদ্রা, যোনিমুদ্রা,উড্ডীনবন্ধ মুদ্রা, মুলবন্ধ মুদ্রা ও খেচরী মুদ্রা। এরমধ্যে শেষোক্ত মুদ্রা অর্থাৎ খেচরী মুদ্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কষ্টসাধ্য,
খেচরী মুদ্রা দেখাইবার একজনও নেই। একমাত্র নিজের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সদগুরুর কৃপা ছাড়া ইহা অসম্ভব। কারণ ঐ মুদ্রার সুফল আমাদের নিকট অচিন্ত্যনীয়। অন্যান্যগুলিও করিলে, যদি সবগুলো না পারো একটি করিলেও অনেক সুফল পাওয়া যাবে। তাই তিনি উপসংহারে লিখিলেন যে যুবকগণ ব্রহ্মচর্য্য পালন করিয়া মরজগতে অমরত্ত্ব লাভ কর। গৃহীগণ এবং গৃহিনীগন
তোমরাও অনেক উপকার পাইবে।
যুবকগণ সকালে দাঁত ব্রাশ করা,তারপর ব্যায়াম করা, তারপরে সর্বাঙ্গে তৈল মাখিয়া শীতকালে উষ্ণজলে এবং গ্ৰীষ্মকালে শীতল জলে চান করিবে। ( বর্তমান সময়ে কলের জলেই সব করিতে হইবে, কারণ কলের জল ছাড়া অন্য জল বর্তমানে বিষের সমান )।
গৃহী এবং গৃহিনীগনের ক্ষেত্রেও সমান নিয়ম পালনীয়।
এরপর স্বামী নিগমানন্দ পরমহংসদেব
সদৃবৃত্তির অনুশীলন করিতে আদেশ করিলেন। ইহা কিরূপ।
গুরুজনের ও বৃদ্ধগণের আজ্ঞানুবর্ত্তী হইবে। ( অবশ্য বর্তমান সময়ে কিছু গুরুজন এবং বৃদ্ধগণ অন্যায় আচরণ করিতে বলিতে পারেন, সেক্ষেত্রে বিচার করিয়া গ্ৰহনযোগ্য না হইলে তাহা অন্যায় বলিয়া বুঝাইবে। তাহাতে ফল না হলে দৃঢ়তার সহিত প্রত্যাক্ষান করিবে। ) দেবতা, ব্রাহ্মণ ও পিতৃগণের নিন্দা করিবে না। প্রাণিগণের উপকারী হইবে।
পরিচিত ও আত্মীয় ব্যক্তির সহিত দেখা হইলে অগ্রে সম্ভাষণ করিবে। উপযুক্ত কালে হিত, মধুর ও পরিমিত কথা কহিবে। কাহারও প্রতি বিদ্বেষবাক্য বা মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিবে না।
পরবর্তী নির্দেশে স্বামী নিগমানন্দ পরমহংসদেব নির্দেশ দিয়েছেন যে
গুরুজনের নিকট উচ্চ আসনে বসিবে না । সভাস্হলে “জৃম্ভণ (হাই), উদ্গার, হাঁচি ও
দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিবে না। স্তম্ভাদিতে ঠেস দিয়া উপবেশন করিবে না। উৎকট ( উবু )
হইয়া কিম্বা রুদ্র আসনে বসা উচিত নহে । বিষম ভাবে গ্রীবাদেশ রাখিবে না। গাত্র, নখ, মুখাদি বাজাইবে না। অকারণে কাষ্ঠ, লোষ্ট্র ও তৃণাদি অভিহনন করিবে না বা ভাঙ্গিবে না ।
অর্থাৎ প্রয়োজন ছাড়া কাঠ, লাঠি এবং ঘাস ছিঁড়িবেনা । এই ছোট ছোট উপদেশে গভীর তথ্য আছে)।
মুখের ফুৎকার দ্বারা অগ্নি জ্বালিবে না। জলে
আত্মপ্রতিবিম্ব দর্শন করিবে না। উলঙ্গ হইয়া জলে প্রবেশ করিবে না।
দ্যূতক্রীড়া করিবে না। মাদকদ্রব্য সেবন করিবে না। গীতবাদ্যাদিতে আসক্তি রাখিবে না। অন্যের জামিন বা সাক্ষী হইবে না। ( অর্থাৎ কোন মালি মোকদ্দমায় নিজেকে জড়াইবেনা )।
নিদ্রা, জাগরণ, শয়ন, উপবেশন, ভ্রমণ, যান,
হাস্য, কথন, মৈথুন ( শ্রী ঠাকুর মহারাজ মৈথুন ব্রহ্মচর্য্য পালনের সময় একদম পরিত্যাজ্য এবং বিবাহিতদের জন্য ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের পর গার্হস্থ্যাশ্রমের আদেশ দিলেন )।ও ব্যায়ামাদি কোন বিষয়েরই অতি সেবা করিবে না।
হিতকর আহার অভ্যাস করিবে। ( নিরামিষ আহার, যেক্ষেত্রে দুগ্ধ, মুগ ডাল, শাকসবজি, প্রভৃতি হয় এবং ঐ নিরামিষ আহারও পরিমিত পরিমাণে ভক্ষন করিতে আদেশ করিলেন )।বহুজনস্পৃষ্ট অন্ন বা পণিকের ( হোটেল-ওয়ালার) অন্ন ভোজন করিবে না।
হস্তপদাদি ধৌত না করিয়া আহার করিবে না। দিবারাত্রির সন্ধি-সময়ে অর্থাৎ প্রাতঃকালে ও সন্ধ্যাকালে এবং সময় অতীত করিয়া ও নিরাসনে আহার করিবে না। ভগ্নপাত্রে বা অঞ্জলিপুটে জলপান করিবে না।
স্বামী নিগমানন্দ পরমহংসদেব এই নিয়মগুলি কৈশোর থেকে গৃহী, গৃহিণী সকলের জন্য প্রতিপালনের আদেশ দিলেন)।
লোম, নথ ঘন ঘন ছেদন করিবে না। মস্তকদ্বারা ভার বহন করিবে না। অন্যের ব্যবহৃত বস্ত্র, মাল্য, পাদুকাদি ব্যবহার করিবে না। মল-মূত্রের উপস্থিত বেগ ধারণ করিৰে
না। অনুপযুক্ত স্থানে বা প্রকাশ্যভাবে মল-মূত্র ত্যাগ করিবে না। গৃহীগণ এবং গৃহিনীগন এর জন্য আদেশ দিলেন যে,
অধিক স্ত্রী-সঙ্গম ( এখানেও ঐ একই নিয়মে ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের পর গৃহীর কি করনীয় তাহাই অনুসরণ করিতে আদেশ করিলেন)করিবে না। রজস্বলা, অকামা, মলিনা, অপ্রিয়া, উচ্চবর্ণা, বয়োজ্যেষ্ঠা, হীনাঙ্গী, ব্যাধিপীড়িতা, গর্ভিণী, যোনিরোগগ্রস্তা, সগোত্রা, গুরুপত্নী, অগম্যা ও প্রব্রজিতা নারীতে গমন করিবে
না।
শ্রী শ্রী ঠাকুর ১০৮ শ্রীমৎ স্বামী নিগমানন্দ পরমহংসদেব লিখিলেন যে
যাহারা শিক্ষার দোষে, বয়সের চাপল্যে এবং কুসংসর্গে পড়িয়া অত্যাচারের নরকবহ্নিতে ঝাঁপ দিয়াছে, আত্মশক্তি বিনষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে, শুত্রু অত্যন্ত তরল হইয়াছে এবং
ধারণাশক্তি বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে, ব্রহ্মচর্য্য পালন ব্যতীত তাহাদের গত্যন্তর নাই। স্বপ্নবিকার, ধাতুদৌর্ব্বল্য প্রভৃতি দুশ্চিকিৎসা কুৎসিত রোগ জন্মিলে আর উপায় নাই ; —ঔষধে এ রোগ আরোগ্য হয় না। ইহার একমাত্র উপায়, একমাত্র চিকিৎসা—ব্রহ্মচর্য্য পালন।
শ্রীশ্রীনিগমানন্দ দেবের তৃতীয় গ্রন্থ ‘ব্রহ্মচর্য-সাধন’। তৃতীয় হলেও সারস্বত গ্রন্থাবলীতে এইটি প্রথম গ্রন্থরূপে চিহ্নিত।
শ্রীশ্রীনিগমানন্দ দেব মনে করতেন যে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক যে কোন ক্ষেত্রেই হক, মানুষকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে গেলে, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে গেলে তার বনিয়াদ শক্ত হওয়া দরকার। মানব চরিত্রের এই শক্ত বনিয়াদ গঠনে দরকার ব্রহ্মচর্য্য চর্চা। তাই প্রাচীনকালে চতুরাশ্রমী ভারতীয় সমাজে ব্রহ্মচর্য্যের স্থানই ছিল মানুষ তৈরীর প্রথম
ধাপ। শ্রীশ্রীনিগমানন্দ দেব তাই ‘যোগীগুরু' ও ‘জ্ঞানীগুরু' গ্রন্থ দু’খানি পূর্বে রচনা করলেও তাঁর গ্রন্থ তালিকায় প্রথমেই স্থান দিয়েছেন ‘ব্রহ্মচর্য্য-সাধন’ গ্রন্থকে। স্বামী নিগমানন্দ পরমহংসদেব পুস্তক পাঠের ক্রম নির্দেশ করে দিয়েছেন।
তাঁর রচিত প্রধান পাঁচটি গ্রন্থ পাঠের ক্রম-নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, 'ধর্ম' পিপাসু ব্যক্তি প্রথমতঃ আপন আপন বর্ণাশ্রমাচারের সহিত ‘ব্রহ্মচর্য্য-সাধন’ গ্রন্থোক্ত নিয়মাবলী পালন করিলে ক্রমশঃ চিত্তশুদ্ধি লাভ করিতে পারিবে ; এরপর স্বামী নিগমানন্দ পরমহংসদেব পরবর্তী আদেশ দিলেন যে,
তৎপরে মনঃস্থিরের জন্য ‘যোগীগুরু,' গ্রন্থোক্ত আসন, মুদ্রা, প্রাণায়াম ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাধনাদি অভ্যাস করিবে । তৎ সঙ্গে সঙ্গে আত্মজ্ঞানের জন্য ‘জ্ঞানীগুরু' গ্রন্থোক্ত তত্ত্ববিচার করিবে, তৎপরে জীবনের চরম লক্ষ্য নির্ধারিত হইলে, স্থূলভাবে 'তান্ত্রিকগুরু' গ্রন্থোক্ত কর্মানুষ্ঠান কিম্বা সূক্ষভাবে ‘যোগীগুরু' বা ‘জ্ঞানীগুরু' গ্রন্থোক্ত যোগ-সাধন করিয়া লক্ষ্যবস্তু উপলব্ধি করিবে। এরপরে শ্রী শ্রী ঠাকুর মহারাজ চরমতম আদেশ দিলেন যে,
তৎপরে এই ‘প্রেমিকগুরু' গ্রন্থোক্ত প্রেমভক্তির অমৃত-প্রবাহে ভাসিয়া গিয়া চিরদিনের জন্য লক্ষ্যবস্তুতে মগ্ন হইয়া নির্বাণ-মুক্তি লাভ করিবে।'
অচিন্ত্যনীয় উপদেশ এবং ক্রম নির্দেশ।
তাই শ্রী ঠাকুর মহারাজের গৃহী হবে জনক, যাজ্ঞ্যবল্ক, ব্যাস, বশিষ্ঠ এবং অম্বরীষ।
গৃহিণীগন হইবেন গার্গী, মৈত্রেয়ী, লীলা, চূড়ালা, সুলভা, মদালসা ও অদ্ভূণ ঋষির কন্যা বাক্ প্রভৃতির মতো। তোমাদের সন্যাসীদের থেকেও কঠোর জীবন যাপন করিতে হইবে।
স্ত্রী, কন্যা, সন্তান সম্পর্কে কঠোর থাকিবে। গড্ডালিকা প্রবাহে সমাজের অন্যদের মতো চলা যাবে না। বৈদেশিক শিক্ষার পাশাপাশি সনাতন ধর্মের পাঠ একসাথে দিতে হবে। নিয়ম পঞ্চক এবং সপ্ত বিধান পালন করিতে হইবে। মঠ আশ্রম রক্ষা করিতে হইবে। তোমার উপর কিছু ভার আমি বহন করার জন্য পাঠিয়েছি। সংসারে যার প্রতি যাহা কর্তব্য তাহা সৎপথে থাকিয়া পালন করিবে। কোন জরুরী কার্য্য ফেলিয়া রাখিবে না। এখানে শ্রী শ্রী ঠাকুর মহারাজের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ প্রাসঙ্গিক বলিয়া লিপিবদ্ধ করিলাম।
১).সাংসারিক ভালবাসা প্রতারণা মাত্র। স্বামী, স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব—সকলের ভালবাসাই চালাকি, স্বার্থের ব্যবসাদারী। একমাত্র গুরু-শিষ্যের ভাবই খাঁটি—এর মাঝে আর কোনও প্রতারণা নাই। জগতে প্রাণ খুলে কারু কাছে কোনও কথা বলা যায় না, একমাত্র গুরুর কাছে বলা যায়। উপদেশ-রত্নমালা। স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী পরমহংসদেব।
২).স্ত্রীই আপাততঃ সুধাবৎ প্রতীয়মান হয়, কিন্তু পরিণামে বিষবৎ ক্লেশপ্রদ। পুত্রদারাদিই মিত্র বলিয়া জ্ঞান হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাহারাই (মিত্ররূপী) শত্রু।
৩). “স্ত্রী’ই এই সংসারের পুরুষকে সুরার ন্যায়
মােহিত করিয়া থাকে। যিনি কামাতুর, তাহাকেই মােহান্ধ বলিয়া জানিবে।
উপদেশ-রত্নমালা - স্বামী প্রেমানন্দ সরস্বতী। পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৫৫।
তিনি বলেছেন যে এই উপদেশাবলি মনে মনে জানিবে বাইরে দেখাবে সংসারের সবাই প্রিয়। সংসারে যার প্রতি যাহা কর্তব্য তাহা আমার উপদেশ মতো পালন করিবে। এই উপদেশগুলির সমর্থনে নিজের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা করিলেন। শ্রী শ্রী ঠাকুর মহারাজ তাঁর গুরুদেবের চরণে নিবেদন করিলেন যে,
আমার প্রথম গুরু সংসার— অর্থাৎ পিতা, ভাই-ভগ্নী, স্ত্রী-পুত্র, মাতামহী, মাতৃস্বসা, আত্মীয়স্বজন। কেননা, তাঁহাদের ব্যবহারে বুঝিলাম, মায়া মমতা স্বার্থের দাস। স্বার্থহানি হইলে পিতা-—পুত্রস্নেহ বিসর্জন দিতে পারেন, ভাই-ভগ্নী শত্রু, হইতে পারে, স্ত্রী-পুত্র—বুকে ছোরা বসাইতে পারে, পরে লিপিবদ্ধ করিলেন যে মাতামহী-মাতৃত্বসা—বিষ উদ্গীরণ করিতে পারেন, আত্মীয়-স্বজন—পদদলিত করিতে পারেন। যদিও সংসারে কোন অভাব অনুভব
করি নাই, তথাপি অলক্ষ্যে কে যেন জানাইয়া দিত, “সংসারে সকলেই স্বার্থদাস।” স্বার্থান্ধগণ কেহই দেখিলেন না যে তাঁহাদের ব্যবহারে আমার হৃদয় কোন উপাদানে গঠিত হইতেছে।
তাহার পর গুরুদেবের চরনে নিবেদন করিয়া আবার লিখিলেন যে***
আরও বুঝিলাম, রোগে-শোকে মানবের পঞ্জরাস্থি ভগ্ন, হৃদয়ের রক্ত শুষ্ক ও মর্মগ্রন্থি শিথিল হয়। ক্ৰমে বুঝিলাম, মহতে দরিদ্র দেখিলে উপহাস করে—নিরন্ন বা ব্যাধি-
গ্রস্তের কাতর প্রার্থনা পাগলের প্রলাপবাক্য বলিয়া উড়াইয়া দেয়—দুঃখীর দীর্ঘনিঃশ্বাস দেখিয়া পাপের ফল বলিয়া ঘৃণা করে।
হায় ! মনুষ্যহৃদয় দয়ামায়া, সহানুভূতি ও পরদুঃখকাতরতার পরিবর্ত্তে কেবল হিংসা, দ্বেষ, নিষ্ঠুরতা ও পরশ্রীকাতরতায় পরিপূর্ণ। সুতরাং প্রথম শিক্ষায় সংসারে বিতৃষ্ণা জন্মিল।
তাই বলিতেছি “সংসার প্রথম গুরু।"
শ্রী শ্রী ঠাকুর মহারাজ সংসার সম্পর্কে পরিস্কার সনাতন ধর্মের মত লিখিলেন। কিন্তু আমরা এতটাই অধম যে তাঁহার ইচ্ছার কনামাত্রও অনুধাবন করিতে পারিতেছি না।
আত্মচেষ্টা এবং গুরুকৃপা ছাড়া এই নিগুঢ় তত্ত্ব এইসব হৃদয়ে ধারণ করা যায় না।