কুলুই মঙ্গল চণ্ডীর ব্রতএর সঠিক সময় বা কাল – অগ্রহায়ণ মাসের মঙ্গলবারে এই ব্রত করার নিয়ম।
কুলুই মঙ্গল চণ্ডীরব্রতের দ্রব্য ও বিধান – পিটুলি গোলা, কুল গাছের ডাল, জোড়া কুল, জোড়া কলা, দুর্বা এবং ফুল। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি মঙ্গলবারে উঠোনে পিটুলির আলপনা দিয়ে সেখানে কুল গাছের ডাল পুঁততে হবে।
তার নিচে ঘট বসিয়ে জোড়া কলা, জোড়া কুল, চিড়ে, মিষ্টি ও পাটালি দিয়ে ধান-দুর্বার অর্ঘ্য গড়ে মা মঙ্গলচণ্ডীর পুজো। করাই বিধি। পুজোর শেষে পাঁচজন এয়োকে
নিয়ে ব্রতকথা শুনে, মন্ত্র বলে ফলার খাওয়া কর্তব্য। জল পান ও ফলার করার আগে স্ত্রীলোকেরা নিচের মন্ত্র গুলি পাঠ করবনে।
এই মন্ত্রটি পাঠ করবনে –
সোনার মঙ্গলচণ্ডী রূপোর বালা।
কেন মা মঙ্গলচণ্ডী এতো বেলা?
হাসতে খেলতে–পাটের শাড়ী পরতে, তেল-হলুদ মাথাতে—আঘাটায় ঘাট করণীতে,
অসহ্য সহ্য করতে–রাজ্যহীনকে রাজ্য দিতে,
আইবুড়োর বিয়ে দিতে—হা-পুতির পুত্র দিতে,
নির্ধনেরে ধন দিতে—কানার চক্ষু দিতে
অন্ধেরে নড়ী দিতে তাই এতো বেলা।
কুলুই মঙ্গল চণ্ডীরব্রতের ব্রতকথা—অনেক দিন আগেকার কথা। এক ব্রাহ্মণ আর এক ব্রাহ্মণী এক গ্রামে বাস করত। তারা রোজ মা মঙ্গলচণ্ডীর ঘটে পুজো করত, পুজোর যোগাড় করে দিত তাদের মেয়ে।
একদিন ঠাকুরঘর পরিষ্কার করতে এসে মেয়েটি দেখল যে, একটা জোড়া কলা রাখা রয়েছে। সে ভাবল যে জোড়া কলায় তো আর পুজো হবে না, তাই মনে করে সে কলাটি খেয়ে ফেলল।
এর ফলে মা মঙ্গলচণ্ডীর ইচ্ছেয় কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটির গর্ভ হল। কুমারী মেয়ের গর্ভ হয়েছে দেখে তার বাপ-মা সমাজের ভয়ে আর লোকলজ্জায় মেয়েটিকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিল।
মেয়েটি কোথাও জায়গা না পেয়ে শেষে এক গভীর বনের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিল। সেখানে সে গাছের ডালপালা দিয়ে একটা কুঁড়ে ঘর তৈরী করে বাস করতে লাগল। কিছুদিন যাবার পর মেয়েটির দু’টি যমজ ছেলে হল। সে তাদের নাম রাখল আকুলী ও সুকুলী।
বড় হয়ে দুই ভাই একদিন কাছেই নদীর তীরে খেলা করছিল। সেই সময় এক সওদাগর বাণিজ্যের পর সাতটি নৌকোয় ধন-রত্ন বোঝাই করে দেশে ফিরছিল। ছেলে দু’টি তাকে বলল,
“আমরা বড় গরীব, আমাদের কিছু দিয়ে যাও।” সওদাগর বলল, “নৌকোয় শুধু গাছপালা ছাড়া আর কিছু নেই।” ছেলে দু’টি বলল, “তবে তাই হোক”।
কিছুদূর যাবার পর সওদাগর দেখল যে, সত্যিই নৌকোয় গাছপালা ছাড়া আর কিছু নেই। তখন সে নৌকো ফিরিয়ে তখুনি ছুটে এল ছেলে দু’টির কাছে আর তাদের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“বাবা! আমার সব গেছে, সর্বনাশ হয়েছে, আমার যেমন ছিল তোমরা আবার তেমনটি করে দাও বাবা তোমাদের পায়ে ধরছি আমি।”
ছেলেরা বলল যে, তারা এর কিছুই জানে না। তারা তাদের মার কাছে গিয়ে সব কথা বলল। তাদের মা তখন মা মঙ্গলচণ্ডীকে সব কথা জানাল, মা মঙ্গলচণ্ডী দৈববাণী করে তখন সওদাগরকে বললেন,
“তুই আমার ব্রতদাসের অপমান করেছিস তাই তোর এই অবস্থা হয়েছে। তুই ঘরে ফিরে গিয়ে এখুনি মা কুলুই মঙ্গলচণ্ডীর পুজো করার ব্যবস্থা কর, আবার তোর সব ফিরে পাবি।
এই পুজোর নিয়ম হল যে, অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি মঙ্গলবার উঠোনে আলপনা দিয়ে কুল-ডাল পুঁতে ঘট বসাতে হবে, তারপর জোড়া কলা, জোড়া কুল, চিড়ে, গুড় ও ধান-দুর্বার অর্ঘ্য সাজিয়ে পুজো করতে হবে।
পাঁচজন এয়ো এক জায়গায় বসে আকুলী, সুকুলীর কথা শুনে ফলার করবে। মা মঙ্গলচণ্ডীর কাছে যে যা প্রার্থনা করবে সে তাই পাবে। তার কুলেও কখনো কলঙ্ক পড়বে না।
সওদাগর বাড়িতে এসে খুব ঘটা করে ভক্তির সঙ্গে মা মঙ্গলচণ্ডীর পুজো আর ব্রত করার পর তার হারানো সব জিনিসই ফিরে পেল।
এরপর একদিন মা মঙ্গলচণ্ডী আকুলী, সুকুলী আর তাদের মাকে সঙ্গে নিয়ে সেই ব্রাহ্মণের বাড়িতে গেলেন। সেখানে গিয়ে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীকে দেবী বললেন, “তোদের মেয়ে মহাসতী। মঙ্গলবারে জোড়া কলা খেয়েছিল বলে
আমার ইচ্ছেয় কুমারী অবস্থাতেই তার যমজ ছেলে জন্মেছে। আকুলী, সুকুলী নামে যমজ ছেলে দু’টি আমার ব্রতদাস, এদের যে অপমান করবে তার আর সর্বনাশের শেষ থাকবে না।” এই কথা বলে দেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
কিছুদিন পরে মা মঙ্গলচণ্ডী সেই দেশের রাজাকে স্বপ্নে গুল দিয়ে বললেন, “তুই রাজপুত্রের সঙ্গে ওই ব্রাহ্মণের মেয়ের বিয়ে দে—তা না হলে তোর সর্বনাশ হবে।” রাজা ভীষণ ভয় পেয়ে রাজপুত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মণ-কন্যার বিয়ে দিলেন।
আকুলী-সুকুলীকে তখন সকলে দেবতার মত ভক্তি শ্রদ্ধা করতে লাগল। সেই সময় থেকে মা কুলুই মঙ্গলচণ্ডীর মাহাত্ম্যের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
কলুই মঙ্গলচন্ডী ব্রত করলে ব্রতকথার শেষে মন্ত্র পাঠ করতে হয় –
মন্ত্র –
সোনার মঙ্গলচণ্ডী রূপোর বালা।
কেন মা মঙ্গলচণ্ডী এতো বেলা?
হাসতে খেলতে–পাটের শাড়ী পরতে, তেল-হলুদ মাথাতে—আঘাটায় ঘাট করণীতে,
অসহ্য সহ্য করতে–রাজ্যহীনকে রাজ্য দিতে,
আইবুড়োর বিয়ে দিতে—হা-পুতির পুত্র দিতে,
নির্ধনেরে ধন দিতে—কানার চক্ষু দিতে
অন্ধেরে নড়ী দিতে তাই এতো বেলা।
ব্রতের ফল—অগ্রহায়ণ মাসের মঙ্গলবারে এই ব্রত করলে ব্রতীর কুলে কখনও কলঙ্ক পড়ে না।
মূলা ষষ্ঠীর ব্রত এর সঠিক সময় বা কাল–অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন স্ত্রীলোকেরা উপোস করে থেকে এই ব্রত করতে পারে।
মূলা ষষ্ঠী ব্রতের দ্রব্য ও বিধান—মূলো, কলা, পান আর ময়দা। এই ব্রতের বিধান অনুসারেসেদিন উপোস করে থেকে মা ষষ্ঠীর পুজো করতে হয়। সেই দিন মাছ ও মাংস খাওয়া একেবারে বারণ। রুটি আর মূলোর তরকারী খাওয়াই ব্রতের বিধান।
মূলা ষষ্ঠী ব্রতের ব্রতকথা—এক খুব গরীব ব্রাহ্মণ ছিল। সে ছেলে বৌ নিয়ে কোনো রকমে এক বেলা এক পেটা খেয়ে দিন কাটাতো। একবার তার একটু মাংস খাবার খুব ইচ্ছে হল।
বেচারা অনেক কষ্টে কিছু পয়সা যোগাড় করে আধপোয়া মাংসা এনে তার ছেলের বৌকে রান্না করতে বলল। ছেলের বৌকে মাংসটুকু রাধবার কথা বলে দিয়ে ব্রাহ্মণ নিজের কাজে বেরিয়ে
গেল। এদিকে তার ছেলের বৌ শ্বশুরের অনেক কষ্টে যোগাড় করা মাংসটুকু খুব ভালো করে রান্না করল। সেই সময় বৌয়ের কাছে একজন প্রতিবেশী বসেছিল।
বৌ সেই প্রতিবেশীকে একটু মাংস খেতে দিয়ে বলল, “দ্যাখতো খেতে কেমন হয়েছে?” প্রতিবেশী মাংসটুটু খেয়ে বলল, “একটুখানি মাংস তো, খেয়ে কোনো স্বাদই বুঝতে পারা গেল না।” বৌ তখন তাকে আরও একটু মাংস দিল, কিন্তু প্রতিবেশী সেবারও একই কথা বলল।
বৌ তখন তাকে আরও একটু মাংস চাখতে দিয়ে দেখল, এমনি করে সব মাংসই ফুরিয়ে গেছে। এদিকে শ্বশুর শিগ্গিরই স্নান করে খেতে আসবেন, তখন সে কী করবে সেই কথা ভেবে বৌ অস্থির হয়ে উঠল।
শেষে কোনো রকমে রক্ষে পাবার জন্যে প্রতিবেশীকে বলল, “এই নাও আটআনা পয়সা, যত শিগ্গির পার আমাকে আধপোয়া মাংস এনে দাও, আমি তাড়াতাড়ি রেঁধে রাখি, আমার শ্বশুর হয়ত এখুনি এসে পড়বেন।”
প্রতিবেশী পয়সা নিয়ে মাংস আনবার জন্যে বেরুলো, সে একটু দূরে গিয়েই দেখল যে, একটা বাছুর মরে পড়ে আছে। সে সঙ্গে সঙ্গে পয়সাগুলো নিজের আঁচলে বেঁধে নিয়ে সেই বাছুরের দেহ থেকে আধপোয়াটাক মাংস কেটে এনে বৌকে দিল।
কিন্তু এমন আশ্চর্য্য যে—অনেকটা সময় কেটে গেলেও মাংস কিন্তু একটুও সেদ্ধ হল না! বৌয়ের তখন ভয়ানক ভয় হল। সে শুনতে পেল যে, শ্বশুর ভাত খেতে আসছেন, সে আর সহ্য করতে পারল না, ভয়ে ভাবনায় অজ্ঞান হয়ে গেল। মাংস আর ঝোল ছড়িয়ে পড়ে রইল চতুর্দিকে।
শ্বশুর ও স্বামী জানতে পেরে অচৈতন্য বৌকে তাড়াতাড়ি ঘরে তুলে নিয়ে গেলেন। বৌয়ের জ্ঞান হতে সে ভয়ে ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার স্বামীকে সব কথা বলল। তার স্বামী তখন প্রতিবেশীকে গিয়ে ধরল।
সে তাকে বলল, “মাংস সেদ্ধ হল না কেন, চলো তো দেখি কোথা থেকে মাংস এনেছ।” প্রতিবেশী তখন আর কোনো উপায় না দেখে আসল কথা স্বীকার করল। সেদিন ছিল অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথি।
বৌ তাড়াতাড়ি মা ষষ্ঠীর পুজো করে মরা বাছুরের ওপর সব ফল, জল ছিটিয়ে দিল আর বাছুরও সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে উঠল।
এই ঘটনা দেখে সকলে বৌয়ের খুব প্রশংসা করতে লাগল। সেই সময় হঠাৎ দৈববাণী হল—“মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন মাছ মাংস খেলে গোমাংস খাওয়া হয়, আর সে পাপের কোনো রকমেই খণ্ডন নেই।
এই ষষ্ঠীর দিনে যে মাছ-মাংসের বদলে মুলোর তরকারী দিয়ে রুটি খাবে তার অক্ষয় পূণ্য সঞ্চয় হবে। সেই থেকে এই ষষ্ঠীর নাম হল “মূলাষষ্ঠী”।
মূলা ষষ্ঠী ব্রতের ফল—এই ব্রত পালন করলে সংসারে ছেলে-মেয়ের কোনো রোগ হয় না,তারা নীরোগ হয়ে সংসারে বাস করে।
নাটাই চণ্ডীর ব্রতএর সঠিক সময় বা কাল—অগ্রহায়ণ মাসে প্রতি রবিবার সন্ধ্যের সময় প্রদীপ জ্বেলে ধূপ-ধুনো দিয়ে ষোড়শোপচারে নাটাই চণ্ডীর পুজো করতে হয়।
সঙ্গে নৌকো ভর্তি সোনা-দানা -” তারপর তিনি সওদাগরের ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার জন্যে একটি সুন্দর টুকটুকে বউ আর তোমার বোনের জন্যে রাজপুত্তুরের মত একটা যেন জামাই নিয়ে আসেন।” গিন্নীর কথামতো তারা সেই বরই চাইল। পরের দিন গিন্নী তাদের বেশ ভাল করে খাইয়ে-দাইয়ে মাঠে পাঠিয়ে দিলেন। তারা মাঠে এসে দেখল যে, গরুগুলো বেশ আনন্দে চরে বেড়াচ্ছে এবং ঘাস খাচ্ছে। এরই মধ্যে সওদাগরও অনেক ধন-সম্পদ আর বউ-জামাই নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়িতে এসে ছেলে-মেয়েকে দেখতে পেলেন না। স্ত্রীর মুখে শুনলেন যে, গতকাল থেকে তারা বাড়িতে আসেনি। তাদের কোনো খোঁজ-খবরও পাওয়া যাচ্ছে না।
সঙ্কট মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করার সঠিক সময় বা কাল – আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের কিংবা অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের যে কোনো মঙ্গলবার এই ব্রত নিতে হয়। দু’জন সধবা স্ত্রীলোকের একসঙ্গে এই ব্রত পালন করার নিয়ম।
সঙ্কট মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতে কি কি দ্রব্য লাগে ও তার বিধান- দূর্বা, আতপচাল, রেশমী কাপড়ের একটা টুক রো, কলাপাতা ও নিরামিষ তরকারী।
আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের কিংবা অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের যে কোনো মঙ্গলবার, আটগাছা দুর্বা ও আটটি আতপচাল, একটা রেশমী কাপড়ের টুকরোয় বেঁধে অর্ঘ্যতৈরি করে রাখতে হবে।
তারপর নিজে কুটনো কুটে আর বাটনা বেটে রান্না করবে। দু’জন সধবা স্ত্রীলোককে একসঙ্গে এই ব্রত পালন করতে হয়। দুজনে একসঙ্গেই কুটনো বাটনা করে নিয়ে নিরামিষ তরকারী রান্না করে একসঙ্গে খেতে বসবে।
খাওয়ার শেষে ভাতের সঙ্গে দই মেখে নেওয়া প্রয়োজন। খেতে বসে কোনো কথা বলা চলবে না। এবং বা হাত, দুই হাটুর ভেতর রাখার নিয়ম।
খাওয়া শেষ হয়ে গেলে দুজনেই দু’জনকে জিজ্ঞাসা করবে, “সঙ্কট থেকে উঠবো কী?” দুজনেই দু’জনকে বলবে, “হ্যাঁ ওঠো।” খাওয়ার পর পাতা জলে ভাসিয়ে দিয়ে, নিজের হাতে এঁটো জায়গাটি পরিষ্কার করে নিতে হবে।
ব্রতকথা–চন্দ্ৰপতি নামে এক সওদাগর উজানীতে বাস করতেন। চন্দ্রপতি সওদাগর একবার বাণিজ্যে বেরিয়ে বহুদিন ধরে বাড়িতে না ফিরে প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন।
বাড়িতে তাঁর সতীসাধ্বী স্ত্রী তার স্বামীর কোনো খবর না পাওয়ার দরুণ খুবই চিন্তা ভাবনা আর মনোকষ্টে দিন কাটাচ্ছিল। সতীর এই মনোকষ্ট দেখে মা ভবানীর তার ওপর দয়া হল।
মা তখন এক বুড়ী ব্রাহ্মণীর বেশ ধরে সওদাগরের স্ত্রীর কাছে এসে বললেন, “মা, তুমি এমন মনোকষ্টে দিন কাটাচ্ছো কেন?” সাধ্বী তখন বলল, “মা! আমার স্বামী আজ অনেক দিন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে আছেন, তাঁর কোনো খবরই পাচ্ছি না। অনেক সহ্য করেছি, আর আমি পারছি না।ভাবছি আত্মহত্যা করে এই যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাবো।”
মা ভবানী বললেন, “আত্মহত্যা করবার দরকার নেই। তুমি এক কাজ কর মা। সঙ্কট মঙ্গলবারের ব্রত কর। এই ব্রত করলে, তোমার স্বামী শিগগিরই বাড়িতে ফিরে আসবেন। আমি ব্রতের সব নিয়ম বলে দিচ্ছি, সেইভাবে তুমি ব্রত কর, তোমার মনস্কামনা নিশ্চয়ই পূর্ণ হবে।”
এই কথা বলে ব্রাহ্মণী ব্রতের সব নিয়ম সাধ্বীকে বলে দিয়ে চলে গেলেন। ব্রাহ্মণীর কথামত সাধ্বী পাড়ারই তার অন্তরঙ্গ একজন সধবাকে ডেকে এনে, একসঙ্গে দু’জনে এই ব্রত করল আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একটা মঙ্গলবারে।
ব্রতের পরে দু’জনে যখন খেতে বসেছে, সেই সময় তার দাসী এসে খবর দিল যে, কর্তা বাড়ি আসছেন।এই কথা শুনে সাধ্বীর আর আনন্দ ধরে না, সে খাওয়া শেষ হবার আগেই তাড়াতাড়ি উঠে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে ছুটে গেল।
ইতিমধ্যে দাসী দেখল যে, ভাত-তরকারী সবই পড়ে আছে। দাসী সেগুলো খেয়ে নিল আর এঁটো তুলে পাতাগুলো জলে ভাসিয়ে দিয়ে কর্তাকে দেখতে গেল।
কর্তা বাড়ি ঢুকেই দাসীকে দেখতে পেলেন এবং তাকেই নিজের স্ত্রী ভেবে সব জিনিসপত্তর, সোনা দানা, তারই হাতে তুলে দিলেন। নিজের স্ত্রীর দিকে ফিরেও চাইলেন না—দাসীকেই স্ত্রী ভেবে নিয়ে তার সঙ্গেই ঘর করতে লাগলেন।
এদিকে তাঁর সাধ্বী স্ত্রীর আবার আগের মত দুরবস্থা হল। সে আবার দুঃখে পড়ে কেঁদে কেঁদে দিন কাটতে লাগল। সাধ্বীর এই রকম অবস্থা দেখে মা ভবানীর আবার দয়া হল।
তিনি সেই বুড়ী ব্রাহ্মণীর বেশে আবার সাধ্বীর কাছে দেখা দিয়ে বললেন, “মা, ব্রতের নিয়ম বলবার সময়ে আমি তো তোমাকে বলেছিলাম যে, খেতে খেতে উঠতে নেই। খাওয়ার শেষে পাতাগুলো জলে ভাসিয়ে দিতে হয়।
কিন্তু তুমি তো সে সব নিয়ম পালন কর নি মা। স্বামী এসেছে শুনে তুমি খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়েছিলে, তাতেই ব্রতের নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। তোমার দুঃখ আমি আর দেখতে পারছি না তাই দেখা দিলাম। তুমি আবার অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে ব্রত কর।
ঠিক ঠিক সব নিয়ম পালন করলে তোমার আর মনোকষ্ট থাকবে না—স্বামীকেও ফিরে পাবে।” এই কথা বলে। ব্রাহ্মণী চলে গেলেন। সওদাগরের স্ত্রী ব্রাহ্মণীর কথা অনুসারে অগ্রহায়ণ মাসে আবার ব্রত করে সমস্ত নিয়ম ঠিক ভাবে পালন করল।
তার ফলে সে আবার তার স্বামীর ভালবাসা ফিরে পেল এবং বেশ আনন্দের সঙ্গে ঘর করতে লাগল। মা মঙ্গলচণ্ডীর দয়ায় তারা স্বামী-স্ত্রী খুব সুখে দিন কাটাতে লাগল। এইভাবে চারিদিকে সঙ্কট মঙ্গলবারের ব্রতের কথা প্রচার হল। ব্রতের ফল—এই ব্রত পালনের ফলে সমস্ত রকম বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
সেঁজুতি ব্রত কখন করে করা হয় – কার্তিক মাসের সংক্রান্তি অর্থাৎ শেষ দিন থেকে আরম্ভ করে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত প্রত্যেক দিন বিকেলে সেঁজুতি ব্রত বা পুজো করতে হয়। কুমারী মেয়েরাই সেঁজুতি ব্রত করে থাকে।
সেঁজুতি ব্রতের কি কি দ্রব্য লাগে ও তার বিধান- দূর্বা, মধুপর্কের বাটি, এই বাটির মধ্যে থাকবে— দুধ, দই, ঘি, মধু, চিনি আর চন্দন। সেঁজুতি ব্রত চার বছর পালন করে উদযাপন করতে হয়। উদযাপনের সময় তিনজন ব্রাহ্মণকে পরিতোষ করে ভোজন করিয়ে প্রত্যেক ব্রাহ্মণকে একখানি কাপড়, একখানি চাদর, একটি বাটি আর সাধ্যমত ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দিতে হবে।
সেঁজুতি ব্রতের ব্রতকথা—সেঁজুতির ৫২টি ঘর। সেঁজুতির পুজোয় খুব বেশী পরিমাণে দূর্বার দরকার হয়। এর প্রত্যেক ঘরে দূর্বা দিয়ে (পরে লেখা) মন্ত্র বলে পুজো করতে হবে। বাড়ির উঠোনে,’ ছাতে বা দালানে পিটুলি দিয়ে সেঁজুতির প্রত্যেকটি ছবি আঁকতে হবে। মাঝখানে গোল করে একে, তার ওপর ঘট বসাতে হয়।
শিবের চারদিকে থাকবে ১৬টি ঘর। (১) জলভরা ঘট আর ঘটের পাশে একটি প্রদীপ জ্বালাতে হবে। (২) ষোলো ঘর ও শিব, (৩) দোলা,(8) কড়া, (৫) বেগুন পাতা, (৬) শরগাছ, (৭) বেনাগাছ, (৮) বাশের কোড়া, (৯) -যমুনা, (১০) সুপুরি গাছ, (১১) চন্দ্র-সূর্য, (১২) হাট-ঘাট, (১৩) গোয়াল, (১৪) অশ্বত্থ গাছ, (১৫) বঁটি, (১৬) খ্যাংরা,
(১৭) শিবমন্দির, (১৮) লতাপাতা, (১১) নাটমন্দির, (২০) পাকা পান, (২১) ত্রিকোণা প্রদীপ, (২২) হাতে ছেলে, কাঁখে ছেলে, (২৩) ঢেঁকি, (২৪) খাট-পালঙ্ক, (২৫) ধাতা কাতা, (২৬) আম-কাঁঠালের পিঁড়ি, (২৭) যি ও চন্দনের বাটি, (২৮) গহনা, (২৯) রান্নাঘর, (৩০) ঢেঁকি কর্কটি, (৩১) আয়না (৩২) উদ্বিড়ালী, (৩৩) বেড়ি, (৩৪) হাতা, (৩৫) পাখী,
(৩৬) কুলগাছ, (৩৭) কাজললতা, (৩৮) নক্ষত্র, (৩১) সিঁদুর চুপড়ি, (৪০) পানের বাটা, (৪১) শাখ, (৪২) ময়না, (৪৩) দশপুতুল, (৪৪) পাখী, (৪৫) ইন্দ্ৰ, (৪৬) তেরাজ, (৪৭) খট্টা ডুমুর, (৪৮) ধানের মরাই, (৪৯) তালগাছ, (৫০) থুথু -ফেলা, (৫১) থৌ, (৫২) কুঁচ কুঁচতি।
(১) জলের ঘট ও প্রদীপে
হাত দিয়ে-
সাজন পূজন সেঁজুতি।
ষোলো ঘরে ষোলো ব্ৰতী
তার এক ঘরে আমি ব্রতী:
ব্রতী হয়ে মাগি বর ।
ধনে-পুত্রে বাড়ুক বাপ-মার ঘর ॥
(২) ষোলো ঘর ও শিবে
হাত দিয়ে—
হে হর শঙ্কর দিনকর নাথ।
কখনো না পড়ি মূর্খের হাত ।
(৩) দোলায় হাত দিয়ে
দোলায় আসি দোলায় যাই ।
সোনার দর্পণে মুখ চাই ॥
বাপের বাড়ির দোলাখানি।
শ্বশুরবাড়ি যায় ।
আসতে যেতে দোলাখানি
ঘৃত মধু খায় ॥
(৪) কোঁড়ায় হাত দিয়ে—
কোঁড়ার মাথায় ঢালি মৌ।
আমি যেন হই রাজার বউ ।
কোঁড়ার মাথায় ঢালি ঘি।
আমি যেন হই রাজার ঝি।।
কোঁড়ার মাথায় ঢালি চিনি।
আমি হেন হই রাজ-ঘরণী ॥
(৫) বেগুন পাতায় হাত দিয়ে—
বেগুন পাতা ঢোলা ঢোলা ।
মায়ের কোলে সোনার ডেলা ॥
হেন মা পুত বিওলি।
শুভক্ষণে রাত পোহালি।।
(৬) শরগাছে হাত দিয়ে—
শর শর শর
আমার ভাই গায়ের বর
বর বর ডাক পড়ে।
গুয়াগাছে গুয়া ফলে ॥
আমার ভাই চিবিয়ে ফ্যালে ।
অন্যের ভাই কুড়িয়ে গেলে ॥
(৭) বেনাগাছ-
বেনা বেনা বেনা
আমার ভাই গাঁয়ের সোনা ।
সোনা সোনা ডাক পাড়ে।
গা গুচি গুয়া পড়ে ৷
আমার ভাই চিবিয়ে ফ্যালে।
অন্যের ভাই কুড়িয়ে খেলে।।
(৮) বাঁশের কোঁড়া
বাঁশের কোঁড়া, রূপের ঝোড়া ।
বাপ রাজা, ভাই চড়ে ঘোড়া ॥
(৯) গঙ্গা-যমুনায় হাত দিয়ে—
গঙ্গা-যমুনা পুজন।
সোনার থালে ভোজন ॥
সোনার থালে ক্ষীরের লাড়ু।
শাখার আগে সুবর্ণের খাড়ু॥
(১০) গুয়াগাছে হাত দিয়ে—
গুয়াগাছ গুয়াগাছ
মূলটি ধরে মজা ।
বাপ হয়েছেন দিল্লীশ্বর,
ভাই হয়েছেন রাজা ॥
(১১) চন্দ্র-সূর্যে হাত দিয়ে—
চন্দ্ৰ-সূর্য পূজন
সোনার থালে ভোজন ॥
সোনার থালে ক্ষীরের লাড়ু।
শাখার আগে সুবর্ণের খাড়ু ॥
(১২) হাট-ঘাটে হাত দিয়ে—
হাটে-ঘাটে পূজন
সোনার থালে ভোজন ৷।
সোনার থালে ক্ষীরের লাড়ু ।
শাখার আগে সুবর্ণের খাড় ॥
(১৩) গোয়ালে হাত দিয়ে-
গোয়াল ঘর পূজন
সোনার থালে ভোজন ॥
সোনার থালে ক্ষীরের লাড়ু।
শাখার আগে সুবর্ণের খাড় ॥
(১৪) অশ্বত্থ গাছে হাত দিয়ে
অশ্বত্থ তলায় বাস করি।
সতীনের ঝাড় বিনাশ করি ॥
সাত সতীনের সাত কৌটা।
তার মাঝে আমার সোনার ॥
কৌটা
সোনার কৌটা নাড়ি চাড়ি ।
সাত সতীনকে পুড়িয়ে মারি ॥
(১৫) বঁটিতে হাত দিয়ে—
বঁটি বঁটি বঁটি,
সতীনের শ্রাদ্ধে কুটনো কুটি ।
(১৬) খ্যাংরায় হাত দিয়ে—
খ্যাংরা খ্যাংরা খ্যাংরা,
সতীদাকে খ্যাংরে করবো দেশ ছাড়া।
(১৭) শিবমন্দিরে হাত দিয়ে—
হে হর মাগি বর
স্বামী হোক রাজ্যেশ্বর ॥
সতীন হোক দাসী ।
বছর বছর একবার করে
বাপের বাড়ি আসি ॥
(১৮) লতাপাতায় হাত দিয়ে—
লতাপাতা কুলদেবতা ।
সিঁথেয় সিঁদূর পায়ে আলতা।।
(১৯) নাটমন্দিরে হাত দিয়ে—
নাটমন্দির বাড়ি জোড়া।
দোরে হাতি বাইরে ঘোড়া ।।
দাস-দাসী, গো-মহিষী ॥
রূপ যৌবন রাশি রাশি।।
সরুধানে সাত পুতে।
জন্ম কাটুক মোর এয়োস্ত্রীতে ।
(২০) পাকা পানে হাত দিয়ে-
পাকা পান মর্তমান।
আমার স্বামী নারায়ণ ॥
যদি পান পাসুরে ।
তবে দিব সুমূর ॥
(২১) প্রদীপে হাত দিয়ে –
ত্রিকোণা প্রদীপ চৌকোণা
আলো।
অমুক দেবী ব্রত করে জগতের
আলো |
(২২) হাতে ছেলে, কাখে ছেলে-
হাতে পো কাঁখে পো ।
পৃথিবীতে আমার যেন না পড়ে লো ॥
(২৩) ঢেঁকিতে হাত দিয়ে-
ঢেঁকি পড়ন্ত, গাই বিয়স্ত,উনুন জ্বলন্ত ।
কালো ধানে রাঙ্গা পুতে।
জন্ম যেন যায় এয়োস্ত্ৰীতে।।
(২৪) খাট-পালঙ্কে হাত দিয়ে-
খাট পালঙ্ক, লেপ, দোলঙ্গ ।
গির্দ্দে আশে-পাশে ॥
রূপ যৌবন সদাই সুখী।
সোয়ামী ভালবাসে ৷।
পাড়াপড়শী প্রতিবেশী ।
মধু বর্ষে মুখে ।
জন্ম এয়োস্ত্রী পুত্রবর্তী
জন্ম যায় সুখে।।
(২৫) ধাতা কাতায় হাত দিয়ে-
যাতা কাতা বিধাতা
তুমি দাও এই বর।
আমার স্বামী হন যেন
রাজ্যেশ্বর।
(২৬) আম-কাঁঠালের পিড়িতে
হাত দিয়ে—
আম-কাঁঠালের পিড়িখানি
ঘি চপ্ চপ্ করে।
আমার ভাই রাজ্যেশ্বর
সেই বসতে পারে ॥
(২৭) ঘি ও চন্দন বাটিতে
হাত দিয়ে—
ঘি চন্দন দিয়ে পূজি গো হরিষে ।
বেনারসী শাড়ী পরি যেন
রাত্রিবাসে ।
(২৮) গহনায় হাত দিয়ে-
পিটুলিতে আঁকা যে গহনা তার
ওপর দুর্বা দিয়ে পুজো
করবে, সেই গহনার প্রত্যেকটির
নাম বলে মন্ত্র বলবে—যেমন—
আমি দিই পিটুলির বালা।।
আমার হোক সোনার বাসা ।
আমি দিই পিটুলির নথ।
আমার হোক সোনার নথ ॥
(২৯) রান্নাঘরে হাত দিয়ে-
রান্নাঘর পূজন ।
সোনার থালে ভোজন ॥
সোনার থালে ক্ষীরের লাড়ু ।
শাখার আগে সুবর্ণের খাড়ু।।
(৩০) ঢেঁকি কর্কটিতে হাত-
ঢেঁকিলো লো কর্কটি
তোর সো হাটে ঘাটে ।
আমার সো সুবর্ণের খাটে।।
(৩১) আয়নায় হাত দিয়ে—
আয়না আয়না, সতীন যেন হয়
না ।
যদি সতীন হয়, মরে যেন যায় ।।
(৩২) উদবিড়ালীতে হাত দিয়ে—
উদ্বেড়ালী খুদ খা।
স্বামী রেখে সতীন খা।।
(৩৩) বেড়িতে হাত দিয়ে—
বেড়ি, বেড়ি, বেড়ি ৷
সতীন বেটী চেড়ী ॥
(৩৪) হাতায় হাত দিয়ে—
হাতা হাতা হাতা।
খা সতীনের মাথা।।
(৩৫) পাখীর গায়ে হাত দিয়ে-
পাখী পাখী পাখী ।
সতীনকে ঘাটে নিয়ে যায়।
তেতালায় বসে দেখি।।
(৩৬) কুলগাছে হাত দিয়ে-
কুলগাছটি ঝেঁকড়ী ।
সতীন বেটী খেঁকড়ী।।
(৩৭) কালজলতায় হাত দিয়ে—
কাজললতা কাজললতা
বাসরঘর ।
আমার যেন হয় একটি সুন্দর
বর।
(৩৮) নক্ষত্রে হাত দিয়ে –
যতগুলি নক্ষত্র ততগুলি ভাই।
বাসোয়া পুজো করে ঘরে
চলে যাই।
(৩৯) সিঁদূর চুপড়িতে হাত দিয়ে—
সিঁদূর চুপড়ি পূজন ।
সোনার থালে ভোজন।
সোনার থালে ক্ষীরের লাড়ু ।
শাঁখার আগে সুবর্ণের খাড়ু।
(৪০) পানের বাটায় হাত দিয়ে—
পানের বাটা পূজন।
সোনার থালে ভোজন ।।
সোনার থালে ক্ষীরের লাড়ু।
শাঁখার আগে সোনার খাড়ু॥
(৪১) শাঁখে হাত দিয়ে
শাখ সেওল গাঙ নেওল।
বাপ রাজা ভাই বাদশা।।
(৪২) ময়নায় হাত দিয়ে—
ময়না ময়না ময়না ।
সতীন যেন হয় না ।।
(৪৩) দশ পুতুলে হাত দিয়ে –
এক একটি পুতুলে একটি করে
দুর্বা দিয়ে বলতে হবে—
(১) এবার মরে মানুষ হব ।
রামের মত পতি পাব।।
(২) এবার মরে মানুষ হব।
লক্ষ্মণের মত দেওর পাব ।
(৩) এবার মরে মানুষ হব।
দশরথের মত শ্বশুর পাব ।
(৪) এবার মরে মানুষ হব।
কৌশল্যার মত শাশুড়ী পাব।
(৫) এবার মরে মানুষ হব ।
সীতার মত সতী হব ।
(৬) এবার মরে মানুষ হব।
কুম্ভীর মত পুত্রবর্তী হব।
(৭))এবার মরে মানুষ হব।
দ্রৌপদীর মত রাধুনি হব।
(৮) এবার মরে মানুষ হব।
পৃথিবীর মত ধীর হব।
(৯) এবার মরে মানুষ হব।
দুর্গার মত সোহাগী হব।
(১০)এবার মরে মানুষ হব।
যটির মত জেওজ হব।
(৪৪) পাখীতে হাত দিয়ে—
সো পাখী সো পাখী।
আমি যেন হই জন্মমুখী।
(৪৫) ইন্দ্ৰেতে হাত দিয়ে –
ইন্দ্র পুঁজি জোড় করে।
সাত ভাইয়ের বোন হয়ে ।
আলো ধানে রাঙা পূতে।
জন্ম যায় যেন এয়োস্ত্রীতে ।
(৪৬) তেরাজে হাত দিয়ে-
তেরাজ ভেজন তিন কুলে
শ্বশুর-স্বামী, পিতার কুলে।
এক তেরাজ বাপ-মার
এক তেরাজ শ্বশুর-শাশুড়ীর
অন্য তেরাজ আমার স্বামীর।।
(৪৭) খট্টা ডুমুরে হাত দিয়ে—
খট্টা ডুমুর মত মাজাখানি।
হই যেন স্বামী সোহাগিনী।
হিংসেয় মরে সতীন কালি।
দিন রাত পড়ুক চোখে পানি।।
(৪৮) ধানের মরায়ে হাত দিয়ে—
আমার যেন হয় সাত গোলা।
আমি দিই পিটুলির গোলা।
(৪৯) তালগাছে হাত দিয়ে—
তালগাছেতে খাবুই বাসা।
সতীন মরুক দেখতে খাসা।
(৫০) থুথু ফেলা (থুথু ফেলা) –
থুতকুড়ি থুতকুড়ি।
সতীন বেটি আঁটকুড়ি ।
(৫১) থৌতে হাত দিয়ে –
থৌ থৌ থৌ থৌয়ে দিলাম মৌ।
আমি যেন হই রাজার বউ।।
থৌ থৌ থৌ থৌয়ে দিলাম ঘি।
আমি যেন হই রাজার ঝি।।
থৌ থৌ থৌ থৌয়ে দিলাম চিনি।
আমি যেন হই রাজার রাণী।।
দেওয়া দূর্বাগুলো নিম্নমন্ত্র
বলে
কুড়িয়ে নিতে হবে ।
অরুণ ঠাকুর বরণে
ফুল ফুটেছে চরণে
যখন ঠাকুরের আজ্ঞা পাই।
ফুল কুড়িয়ে ঘরে যাই ॥
ওই দূর্বাগুলো শেষ সেঁজুতি
কুঁচ কুঁচুতির ওপর চাপিয়ে “মন চলে
যা” মন্ত্র বলে দূর্বা দিয়ে ঘষবে
(৫২) কুঁচ কুঁচুতি—
কুঁচ কুঁচুতি কুঁচুই বোন,
কেনরে কুঁচুই এতক্ষণ।
মোহর এলো ছালা ছালা,
তাই তুলতে এত বেলা।।
কুঁচ কুঁচুতি কুঁচুই বোন,
কনরে কুঁচুই এতক্ষণ।
টাকা এলো ছালা ছালা,
তাই তুলতে এত বেলা ।।
কুঁচ কুঁচুতি কুঁচুই বোন,
কেনরে কুঁচুই এতক্ষণ।
ধান এলো ছালা ছালা,
তাই তুলতে এত বেলা ।।
কুঁচ কুঁচুতি কুঁচুই বোন,
কেনরে কুঁচুই এতক্ষণ।
চাল এলো ছালা ছালা,
তাই তুলতে এত বেলা
এরপর পৌষ মাসের জন্য দূর্বাগুলো
ভাল করে রেখে দিতে হবে
সেঁজুতি প্রণাম মন্ত্র
সাঁজ সেঁজুতি করি নতি।
আমার হোক ধর্মে মতি ।।
এই বলে প্রণাম করতে হবে।
সেঁজুতি ব্রতের ফল—কুমারী মেয়েরা এই ব্রত পালন করলে তাদের সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ হয়ে থাকে।
অগ্রহায়ণ মাসের প্রত্যেক রবিবার এই পুজো করে অগ্রহায়ণের সংক্রান্তির দিন পুকুর, নদী বা গঙ্গায় ইতু বিসর্জন দিতে হয়। কুমারী ও সধবা সকলেই এই ব্রত করতে পারে।
সিঁদূর, ফুল, দূর্বা, বেলপাতা, তিল হরিতকী, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, সেঁয়াকুল এবং ফল। কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন, একটি বেশ পরিষ্কার সরার মাঝখানে ঘট বসিয়ে তার চারিদিকে ধান, হলুদ, মান ও কচু গাছ একটা করে বসাতে হবে।
এই সঙ্গে মটর, সরষে, শুষনী, কলমী আর পাঁচটি ছোট বটের ডাল দিতে হয়। পুজোর শেষে নীচে লেখা মন্ত্র বলে ঘটে প্রণাম করার নিয়ম।
মন্ত্র –
অষ্ট চাল অষ্ট দূর্বা কলস্ পাত্রে থুয়ে।
শুন একমনে ইতুর কথা সবে প্রাণ ভরে ॥
ইতু দেন বর।
ধন-ধান্যে, পুত্র-পৌত্রে বাড়ুক তাদের ঘর ॥
কাঠি-কুটি কুড়াতে গেলাম ইতুর কথা শুনে এলাম ।
এ কথা শুনলে কী হয়। নির্ধনের ধন হয়।
অপুত্রের পুত্র হয়।অশরণের শরণ হয়।
অন্ধের চক্ষু হয়, আইবুড়োর বিয়ে হয়, অন্তিম কালে স্বর্গে যায়।।
অগ্রহায়ণ মাসের প্রত্যেক রবিবার এই পুজো করে অগ্রহায়ণের সংক্রান্তির দিন পুকুর, নদী বা গঙ্গায় ইতু বিসর্জন দিতে হয়। যে কোনো একজন উপোসী থেকে ইতুর কথা শুনবে। একজন কথা বলবে অপর জন কথা শুনবে।
ইতুপূজা ব্রতকথা—এক রাজ্যে এক খুব গরীব বামুন -বামনী বাস করত। তাদের উমনো আর ঝুমনো নামে দু’টি মেয়ে ছিল। একদিন বামুনের খুব পিঠে খাবার ইচ্ছে হওয়ায় সে সব জিনিস যোগাড় করে নিয়ে এল,
বামনী রাত্তির বেলায় পিঠে করতে লাগল আর বামুন রান্নাঘরের পেছনে চুপ করে বসে পিঠে গুণতে লাগল। এরপর বামুনকে খেতে বসিয়ে বামনী যখন পরিবেশন করছে তখন বামুন বলল, “দু’খানা পিঠে কম হল কেন?” বামনী বলল যে, সে তার মেয়ে দু’টিকে দু’খানা পিঠে দিয়েছে।
এই কথা শুনে বামন খুবই রেগে গেল কিন্তু কিছু বলল না। এরপর একদিন সকাল বেলা বামুন বাসনীকে বলল, আজ উম্নো-ঝুম্নোকে ওদের পিসির বাড়ি রেখে আসব। পিসির বাড়ি থাকলে দুটো খেতেও পাবে আর পরে ওখান থেকেই ওদের বে-ধারও ব্যবস্থা হতে পারবে।
আমার বোনের অবস্থা তো খুব ভাল—আমিই এতদিন অভিমান করে যাইনি। বামনী খুশী না হলেও মুখে কিছুই বলতে পারলো না।
বামুন উম্নো-ঝুম্নোকে নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা হল। অনেকখানি হাঁটার পর বেলা প্রায় দুপুরে বামুন মেয়ে দু’টিকে নিয়ে একটা বনের মধ্যে ঢুকলো।
মেয়ে দু’টি খিদে-তেষ্টায় খুবই কাতর হয়ে পড়েছিল, তারা আর বসে থাকতে পারল না, একটি বটগাছের ছায়ায় তাদের বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
বামুন এইটাই চাইছিল, সুযোগ দেখে সে ইটের ওপর মেয়ে দু’টির মাথা রেখে চুপি চুপি পালিয়ে গেল। যাবার সময় কয়েকটি শামুক ও গুলি ভেঙ্গে তাতে আলতা মাখিয়ে ছড়িয়ে রেখে গেল।
মেয়ে দু’টির ঘুম ভাঙ্গতে দেখল যে—তাদের বাবা সেখানেই নেই আর চারিদিকে খানিক রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে। উমনো তখন ঝুমনোকে বলল, “বাবাকে বোধহয় বাঘে খেয়েছে।” ঝুম্নো বলল, “না না, আমরা যে দু’খানা পিঠে লুকিয়ে খেয়েছিলুলম, তাই বাবা রাগ করে আমাদের পিসির বাড়ি রেখে আসার নাম করে বনে ফেলে চলে গেছে। পিসি বলতে কোনো কালেই আমাদের কেউ নেই।”
এই ভয়ানক, বনের মধ্যে তাদের খুব ভয় করতে লাগল। দু’জনেই চোখের জলে ভাসতে লাগল— কোথায় বা তারা যাবে, তাও ঠিক করতে পারল না। এমন সময় দূরে বাঘের গর্জন শোনা গেল।
বাঘের গর্জন শুনে তার ভয়ে আর আড়ষ্ট হয়ে উঠল , এবার বুঝি তাদের বাঘের পেতে যেতে হবে! তারা তখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে, এমন সময় উমনো বলে উঠল, ” ঝুমনো দি , ঐ দূরে একটি খুব বড় বটগাছ দেখা যাচ্ছে, চলো আমরা ওখানেই আশ্রয় নিই।”
উমনোর কথা শুনে দুজনে ছুটে গেল সেই বট গাছের কাছে। দুজনেই বট গাছের সামনে হাত জোর করে বলল, “বাবা বতরূপী নারায়ণ, আমরা ভয়ানক বিপদে পড়েছি, ঐ শোনো দূরে বাঘের গর্জন – বাঘটা এসে এখুনি আমাদের খেয়ে ফেলবে – তুমি আমাদের আশ্রয় দিয়ে বাচাও।”
উমনো-ঝুমনোর এই কাতর কথা শুনে বট গাছটি তখন দু ফাঁক হয়ে গেল, উমনো ঝুমনো তার সেই কোটরের মধ্যে ঢুকে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে কোটরটা বন্ধ হয়ে গেল।
বাঘটা কাছে এসে মানুষের গন্ধ পেয়ে চারপাশে খানিকটা ঘোরাঘুরি করে সেখান থেকে চলে গেল। বাঘটা চলে যেতেই বটগাছটি আবার দু ফাঁক হয়ে গেল আর উমনো ঝুমনো কোটরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল।
এখন তার কি করবে কোথায় যাবে কি করবে ভাবতে ভাবতে জঙ্গলের মধ্যে চলতে লাগলো। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর তার জনবস্তি দেখতে পেল। বন তখন তার পেরিয়ে এসেছে। তার একটু দূরে দেখল যে তাদের বয়সী কয়েকজন মেয়ে একটা পুকুরের পারে ঘট বসিয়ে কি সব পূজা করছে।
উমনো ঝুমন তাদের কাছে দাঁড়াতেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুজোর ঘট গুলি সব উল্টে পড়ে গেল। সেই মেযেগুলো তখন খুব রেগে গিয়ে বলল ” কথা থেকে অলক্ষ্মী তোমরা এলে যে – আমাদের ইতু পূজার ঘট গুলি সব উল্টে পাল্টে গেল।”
উমনো – ঝুমনো তখন খুব কাঁদতে কাঁদতে তাদের দুখের কথা গুলো সেই সব মেদের কাছে বলতে লাগলো। সব কথা দুই বোনের কাছ থেকে সোনার পর মেয়ে গুলোর তাদের প্রতি দয়া হল।
তখন তারা বলল উমনো ঝুমনো কে বলল, “তোমাদের কোন ভয় নেই, কাঁদতে ও হবেনা তোমরা আমাদের মত ইতু পূজা করো তাহলে তোমাদের আর কোন দুখ থাকবেন।
যাও এখন তোমরা ঐ পুকুর থেকে স্নান করে এসো।” সেই মেয়েদের কথা মত উমনো ঝুমনো যেই পুকুরে নেমেছে অমনি পুকুরের সব জল শুকিয়ে গেল ও পুকুরের মাছ গুলো ছটফট করে লাফাতে লাগলো।
উমনো ঝুমনো এই ব্যাপার দেখে কাঁদতে কাঁদতে আবার মেয়ে গুলর কাছে ফিরে এসে সব কথা বলল। মেয়েরা বলল এই নও ঘটের দুর্ববা দিচ্ছি, নিয়ে পুকুরে গিয়ে ফেলো।”
ওদের কথা মত উমনো ,ঝুমনো দুর্ববা গুলি নিয়ে পুকুরে গিয়ে ফেলতেই আবার পুকুর জলে ভরে গেল।
তখন তারা দুজনে পুকুর থেকে স্নান করে এল । স্নান করে ফিরে এসে মেয়ে দুটি তাদের ঘট আর দূর্বা দিয়ে ইতু পূজা সম্পূর্ণ করল । পুজোর পর দুই মেয়ে বলল ,”এই বার ইতুর কাছে বর চেয়ে নাও ।’
উমনো -ঝুমনো তখন ইতুর কাছে বর চাইল -”ইতু দেবি !এই বর দাও ,যাতে আমাদের বাবা -মায়ের দুখ দূর হয় ,আর ঘর ভর্তি সোনা -দানা ও টাকা -কড়ি হয়। ”তারপর মেয়ে দুটি বলল ,”এইবার তোমরা খুব ভক্তি করে ঘট নিয়ে বাড়ির দিকে যাও ।” তখন ঘট নিয়ে উমনো -ঝুমনো বাড়ির দিকে চলে গেল । ইতু দেবিই তাদের পথ দেখিয়ে দিলেন ।
এ দিকে উমনো -ঝুমনোর বাবা- মা ইতুর বরে রাজার মত ধনবান হল । দুই বোন ক্রমে ঘট হাতে করে বাড়িতে এসে পছল । তাদের বাবা -মা ভেবেছিল যে ,এতদিন মেয়ে দুটিকে অবশই বাঘে খেয়ে ফেলেছে ।
আর ওদের আপদ দূর হয়েছে । এমনি সময় হঠাৎ উমনো ঝুমনোকে বাড়ি ফিরতে দেখে তাদের বাবা অবাক হয়ে বলল ,”তোরা এতদিন বেঁচেছিলি ?কোথা থেকে ফিরে এলি এখন ?মরিস নি তোরা ?”
উমনো বলল, ”বাবা !আমরা যদি মরতুম তাহলে আজ তোমরা এত বড় লোক হতে পড়তে না । আমরাই ইতু পুজো করে মা কে সন্তষ্ট করে তোমার রাজ্য হওয়ার বর চেয়েছিলুম -তাই তুমি আজ এত বড় লোক হতে পেরেছো । ”
তখন তাদের বাবা মা তাদের আদর করে ঘরে নিয়ে গেল । বমনীও তাদের কথা শুনে ইতু পূজা আরম্ভ করল । বছর কয়েক পরে বামন – বামনীর সুন্দর ফুটফুটে পুত্র সন্তান জন্ম নিল ।
তখন তাদের আনন্দ আর ধরেনা । ধন , ঐশ্বর্য ও ছেলে পেয়ে , মেয়ে দের নিয়ে তারা মনের সুখে ঘর সংসার করতে লাগল ।
এই ভাবে কিছুদিন কেটে যাবার পর একদিন এক রাজপুত্র কোটাল পুত্র দুই বন্ধু মিলে অনেক লোকজন সঙ্গে নিয়ে বামুনের বাড়িতে এসে হাজির হল । বেলা তখন দুপুর ,তাঁরা তখন খিদে তেষ্টায় অস্থির ।
রাজপুত্র এসে সামনে উমনো কে দেখে বললেন “আমাদের খুব তেষ্টা পেয়েছে, আমাদের একটু জল খাওয়াতে পর ?” উমনো তক্ষুনি ছুটে গিয়ে একটা ছোট্ট ভাঁড়ে করে জল এনে দিল।
এক ভাঁড় জল খেয়ে রাজপুত্রের খুব ভয়ানক রাগ হল, কিন্তু কি আর করবেন, ভাবলেন যেটুকু জল পাওয়া গেছে, সেই টুকুই এখন খেয়ে নেওয়া যাক। এইভেবে রাজপুত্র ভাঁড় টি মুখে তুলে জল খেতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, যত জল ক্ষণ ভাঁড়ের জল আর কিছুতেই ফুরায় না।
তখন তিনি তার লোক লস্কর সকলকে সেই ভাঁড়ের জল খেরতে দিলেন, তারাও রান ভরে জল ,খেল তবুও ভাঁড়তের জল যেমন ছিল তেমনি রইল। তখন সকলে উমনোকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো।
রাজপুত্র উমনোকে বললেন তার বাবাকে ডেকে আনতে। ,উমনো গিয়ে বামুন কে ডেকে আনলো।
রাজপুত্র বামুনকে বললেন “আপনার মেয়েটি বড় ভাল আমি মদ্র দেশের যুবরাজ, যদি আনার কোনোম আপত্তি না থাকে তাহলে আমি আনার এই মেয়েটি কে বিয়ে করতে চাই।”
বামুন তখন বললেন , ” আপত্তি আমার কিছু নেই তবে আমার আর একটি মেয়ে আছে, তারও এখন বিয়ে হয়নি।” যুবরাজ বললেন ” আমার সঙ্গে আছে কোটাল পুত্র আমার বন্ধু। আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের দুইজনকে দুই মেয়ে দান করতে পারেন।”
বামুন দেখে চমত্কার সুযোগ সে আর দেরি করলনা, গধূলি লগ্নে উমনোর সঙ্গে যুবরাজের আর কোটাল পুত্রের সঙ্গে ঝুমনোর বিয়ে দিয়ে দিল। অরের দিন উমনো ঝুমনো শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় বামনী বললেন “তোরা কি খেয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবি” উমনো বলল
“আমি এখন রাজার রানী দাদ খনি চলের ভাত আর মাগুর ম্যাচের ঝোল ভাত করে রেঁধে দাও, আমি তাই খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে হাতির পিঠে বসে শ্বশুর বাড়িতে যাব। আর ঝুমনো বলল “আজ অগ্রহায়ন মাসের রবিবার, ফলমূল নিরামিষ খেয়ে ইতুর ঘট মাথায় নিয়ে আমি হাতির পিঠে চড়ে শ্বশুর বাড়ি যাব।”
শেষ পর্যন্ত দুই বোনের খাওয়ার দুইরকম ব্যবস্থা হল। তারা খেয়ে দিয়ে যে যার স্বামীর সঙ্গে হাতির পিঠে চড়ে শ্বশুর বাড়িতে রওনা হল।
উমনো যে পথ দিয়ে যেতে লাগলো সেখানে তাদের সামনে পড়ল গৃহ দাহ, মড়ক, দুর্ভিক্ষ ও যত সব অমঙ্গলের চিহ্ন। আর ঝুমনো যে পথ দিয়ে যেতে লাগলো দেখতে পেল বিয়ে, সভা সমিতি, অন্ন প্রাশন ও অন্যান্য পূজা পার্বণ।
এইভাবে উমনো যবরাজের সঙ্গে রাজার বাড়িতে এসে হাজির হল। রনি মা ওদের আসবার খবর বয্ব বউ বরণ করতে এলেন। কিন্তু বউ যেমনি হাতি থেকে নামলো তেমনি রাজার বাড়ির সিংহ দরজা তা হুড়মুর করে ভেঙে পড়ল,
যুবরাজের মা অনেক বোকা ঝক করে বোউকে ঘরে তুললেন। এইদিকে কোটাল পুত্রের মা বউ বরণ করতে এসে দেখলেন তাদের বাড়ির লোহার গরদ গুলো সব সোনার হয়ে গেছে। কোটাল পুত্রের মা বোউকে কোলে করে আদর করে ঘরে তুললেন।
উমনো রাহবাড়িতে আসার পর মদ্র যুবরাজের ধন ঐশ্বর্য বিষয় সম্পত্তি সব ক্রমে ক্রমে কোথায় চলে গেল। যুবরাজ একেবারে ভিখারী হয়ে পড়লেন। আর ঝুমনো কোটলের বাড়িতে আসার পর থেকে কোটলের বাড়ি ধন এশ্বর্য পরিপূর্ণ হয়ে সংসার
একেবারে উতলে পড়তে লাগলো, সারা দেশে প্রচার হয়ে গেল যে কোটাল পুত্র এক খুবই সুলক্ষণ যুক্ত মেয়ে বিয়ে কে এনেছে। তাদের এখন সব দিকে বার্বারন্ত।
মদ্র যুবরাজ উমনোকে অলক্ষী ভেবে নিয়ে তার উপর খুবই চোটে গেলেন, উমনো তার সামনে এলে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে লাগলেন। শেষ একদিন ঘাতক ডেকে বললেন এই দণ্ডেই উমনোকে কেটে তার রক্ত এনে ম আমাকে দেখাও।
ঘাতক যুবরাজের হুকুমে উমনোকে মশানে নিয়ে গিয়ে ছেড়েদিল, আর একটা শিয়ালকে কেটে এনে তার রক্ত যুবরাজে কে দেখাল। উমনো তখন ঝুমনোর কাছে গিয়ে সবটাই খুলে বলল।
মায়ের পেটের বোনের এই রকম দুর্গতির কথা শুনে ঝুমনো কাউকে জানতে না দিয়ে তার বনে তার বাড়িতে লুকিয়ে রাখল। এমন কি তার স্বামী কোটাল পুত্র ও জানতে পারলেন না ঝুমনো বুঝল যে তার বোন ইতুর অসম্মান করেছে তাই সে আজ এই বিপদে পড়েছে।
তখন থেকে ঝুমনো আবার উমনোকে নিয়ে ঠিক নিয়ম মত ইতু পুজো করতে লাগলো। শেষে ইতু দেবী আবার উমনোর উপর সন্তুষ্ট হলেন। সঙ্গে সঙ্গে যুবরাজের দিন দিন বার্বারন্ত হতে লাগলো।
যুবরাজ একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে, এক দেবী তাকে বলছেন “এখুনি উমনো রানীকে খুঁজে বাড়িতে না নিয়ে এলে তর সর্বনাশ হয়ে যাবে”। মদ্র যুবরাজ স্বপ্ন দেখার পর থেকে খু বই চিন্তায় পড়লেন।
তিনি তো জানতেন যে ঘাতক উমনকে কেটে ফেলেছে। শেষে যুবরাজ কোটাল পুত্রকে ডেকে এনে স্বপ্নের কথা জানালেন। কোটাল পুত্র তখন ঘাতক কে ডেকে উমনোর কথা শুনলেন এবং খুব ভাবতে ভাবতে বাড়ি তে চলে গেলেন।
কোটাল পুত্র উমনো আর যুবরাজ এর জন্য খুব দুঃখ করতে লাগলেন। ঝুমনো স্বামীর এই রকম চিন্তার কারণ জিজ্ঞেস করে উমনোর ব্যাপারে জানতে পারল।
তখন সে তার স্বামী কে বলল ” মা ইতুদেবির আশীর্বাদে যুবরাজ আবার উমনকে ফিরে পেতে পারেন যদি আমার কথা মত কাজ করেন। তুমি যুবরাজকে বল যে আমাদের বাড়ি থেকে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত কলাগাছ পুঁতে
তাঁবু ফেলে যদি কড়ির জাঙ্গাল দিয়ে দিতে পাড়েন তাহলে আবার উমনকে ফিরে পেতে পারেন।” কোটাল যুবরাজকে সেই কথা বলল। যুবরাজ উমনকে পাওয়ার আশায় সমস্ত ব্যবস্থাই করে দিলেন।
ঝুমনো তখন উমনকে রাণীর সাজে সাজিয়ে তাঁবুর মধ্যে দিয়ে রাজবাড়িতে পাঠিয়ে দিল। উমনোর চলার ওঠে দুর্বার শিকড় পড়েছিল সেই দুর্বার শিকড়ে লেগে উমনোর প কেটে গেল।
যুবরাজ এটাতে খুবই রেগে গিয়ে হুকুম দিলে এই দণ্ডে আঠারো হাঁড়ির মাথা আর তাদের বুড়ি মাযের চোখ দুটো উপরে অন হক। যুবরাজের বলার সঙ্গে সঙ্গেই হুকুম মত কাজ করো হল।
যুবরাজ উমনকে নিয়ে রাজবাড়িতে ঢুকলেন। তারপর অগ্রহায়ন মাসে উমনো ইতুপুজো করল কিন্তু ইতুর কথা সুনবর মত রাজবাড়িতে কোন স্ত্রীলোক পেলনা।
উমনো তখন যুবরাজকে বলল য়ে একজন উপসি স্ত্রীলোক চাই, যে ইতুর কথা সংবে। যুবরাজ তখনই লোক পাঠালেন, রাজ্যের মধ্যে যে স্ত্রীলোক উপসি আছে টেক রাজবাড়িতে নিয়ে আসার জন্য।
রাজবাড়ির লোক ছুটল চারিদিকে কিন্তু রাজ্যে কোন উপসি মেয়ে পেল না। শেষে তার সেই বুড়ি হাঁড়িনীকে জেনে ধরে আনলো। সে কিছুতেই অসবেনা-সে বলতে লাগলো “ঐ অলক্ষ্মী রাক্ষসীর জন্য আমার আঠারো ছেলের মাথা গেল আর আমি অন্ধ হয়ে গেলুম-আমি কিছুতেই সেখানে যাবনা।”
যায় হক রাজবাড়ির লোকের তাকে জোর ধরে আনলো। সে উমনোর কাছে আসতেই উমনো তাকে বলল “বুড়িমা, তোমার কোন ভয় নেই, তুমি আমার ইতুর কথা শোনো, আবার তোমার সব হবে।”
বুড়ি তখন তার আঠারো ছেলের আর তার চোখ ফিরে পাওয়ার জন্য বর চাইল। মা ইতু লক্ষ্মীর আশীর্বাদে তাই হল। বুড়ি তার আঠারো ছেলেকে আর নিজের চোখ ফিরে পেল। এরপর হাঁড়িনী চারিদিকে বলে বেড়াতে লাগলো যে
রাণী মা উমনোর ইতু লক্ষ্মী পুজোর কথা শুনে সে আবার তার সব ফিরে পেয়েছে। তখন থেকে গোটা দেশ বাসী সকলে ইতুর পুজো করে আনন্দে বসবাস করতে লাগলো।
ইতু লক্ষ্মী ব্রতের ফল -এই ইতু ব্রত পূজা করলে মেয়ের যথার্থ সুখ-সম্পদের অধিকারিণী ও স্বামীর প্রিয়া হয়ে থাকেন।