আহার
"অসাবি দেবং গোঋজীকমন্ধো ন্যস্মিন্নিন্দ্রো জনুষেমুবোচ।
বোধামসি ত্বা হয়র্শ্ব য়জ্ঞৈবোধা ন স্তোমমন্ধসো মদেষু॥"
সরলার্থঃ আহার সেটিই উত্তম যা কিনা উৎপাদন করা হয়েছে। আহার ভূমিমাতা থেকে উৎপন্ন শস্যাদিরই করা উচিত, সাথে গোদুগ্ধ। এই আহারই সাত্ত্বিক ও দৈবী সম্পত্তির জন্মদাতা। এই সাত্ত্বিক ভোজনে নিশ্চিতভাবেই, স্বভাবতই ইন্দ্রিয়সমূহের শাসক হওয়া যায়, দাস নয়। অর্থাৎ সাত্ত্বিক ভোজন দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহকে বশীভূত করা যায়। পক্ষান্তরে রাজসিক ও তামসিক আহার ইন্দ্রিয়ের দাসত্বের কারণ। প্রভু উপদেশ দিচ্ছেন শীঘ্রতাযুক্ত ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বযুক্ত মানব! তোমাকে যজ্ঞসমূহ দ্বারা জ্ঞানযুক্ত করি। ভক্ত বলছেন, সাত্ত্বিক আহারের আনন্দে বিহ্বলিত আমাদের স্তুতি সমূহকেও জ্ঞাত হও। অর্থাৎ, সাত্ত্বিক আহারী মানব প্রভুকে বিস্মৃত হয় না। বরং সর্বদা স্মরণ করে।
অগ্নি বা জল দ্বারা রন্ধনের নির্দেশ এবং কুতর্ক দ্বারাও মাংসাহার নিষিদ্ধকরণ -
“যে বাজিনং পরিপশ্যন্তি পক্বং য ঈমাহুঃ সুরভির্নির্হরেতি । যে চার্বতো মাংসভিক্ষামুপাসত উতো তেষামভিগূর্তির্ন ইন্বতু ॥” ঋ০ ১।১৬২।১২ অর্থাৎ যে মনুষ্যগণযাতে বিবিধ অন্নাদি পদার্থ বিদ্যমান সেই ভোজনকে রন্ধন করার ফলে উত্তম হওয়া খাদ্যকে সর্বদিক থেকে দর্শন করে বা যে জল দ্বারা রন্ধনকৃত বলা হয়ে থাকে এবং যারা প্রাপ্ত হওয়া প্রাণীর মাংস না প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তর্ক-বিতর্ক দ্বারা সেবন করে তাদের উদ্যম এবং সুগন্ধ আমাদের ব্যাপ্ত বা প্রাপ্ত হোক। হে বিদ্বান! তুমি এই রকমের অর্থাৎ মাংসাদি অভক্ষ্যসমূহকে ত্যাগ করার মাধ্যমে রোগসমূহকে নিরন্তর দূর করো।
“ব্রীহিমত্তং যবমত্তমথো মাষমথো তিলম্। এষ বাং ভাগো নিহিতো রত্নধেয়ায় দন্তৌ মা হিংসিষ্টং পিতরং মাতরং চ ॥” অথর্ব০ ৬।১৪০।২ অর্থাৎ চাউল, যব, মাষ এবং তিল ভক্ষণ কর। রমণীয়তার জন্য ইহাই তােমাদের জন্য বিহিত হয়েছে! পালক ও রক্ষককে ভক্ষণ কোরো না ,
“পূরুষঘ্নং ক্ষয়দ্বীর সুম্নমস্মে তে অস্তু” ঋ০ ১।১১৪।১০
অর্থাৎ মনুষ্যগণকে হত্যা এবং গো আদি উপকারী পশুসমূহের বিনাশকারী প্রাণীগণকে নির্মূল করে আপনার এবং আমাদের জন্য সুখ হোক ,
’শর্ম যচ্ছত দ্বিপদে চতুষ্পদে’ ঋ০ ১০।৩৭।১১
অর্থাৎ দ্বিপদী-মনুষ্য এবং চতুষ্পদী-পশুগণের জন্য সুখ প্রদান করো ।
“ক্রব্যাদো মা তে হেত্যা মুক্ষত দৈব্যায়াঃ” অথর্ববেদ ৮।৩।১৮ , ৫।২৯।১১ , “য আমং মাংসমদন্তি পৌরুষেয়ং চ যে ক্রবিঃ “
অর্থাৎ যে কাঁচা মাংস খায় ও যে মনুষ্যের মাংস খায় এবং ক্লেশ প্রদানকারী গর্ভকেও খেয়ে ফেলে; সেই দুষ্ট প্রাণীদের এখান থেকে বিনষ্ট করা হোক। মাংস ভক্ষকগণ ঈশ্বরের দিব্য গুণযুক্ত বজ্র তথা ন্যায়বিচার ও শৌর্যবীর্য দ্বারা রক্ষা পায় না৷
ব্রহ্মসূত্রে বলা আছে- আপৎকাল ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে বিচার বিবেচনা করতে হবে। "সর্ব অন্ন অনুমতিঃ প্রাণাত্যয়ে চ তদ্দর্শনাৎ।"
অর্থাৎ সর্বপ্রকার খাদ্য গ্রহণ করার অনুমতি কেবল জীবন বিপন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ স্মৃতিতে এরূপ নির্দেশ আছে।
বেদে যেকোনো প্রকারের মাংস আদি উৎসর্গ নিষিদ্ধ রয়েছে। কারণ ঈশ্বর রক্ত পিপাসু নন। তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কোন পশু হত্যার প্রয়োজন নেই। তাঁর উপাসনা আমরা করি কেবল আত্মশুদ্ধির জন্য। বৈদিক যজ্ঞ সর্বদাই পবিত্র সেখানে কোনোরূপ হত্যা সম্ভব নয়। সে জন্যই বেদ যজ্ঞকে অধ্বর সংজ্ঞা দিয়েছে।
বেদে মাংসাহারের নিষেধে অনেক নির্দেশনা রয়েছে যেমন-
“যঃ পৌরুষেয়েণ ক্রবিষা সমঙ্ক্তে যো অশ্ব্যেন পশুনা যাতুধানঃ “
অর্থাৎ যে যাতনা দানকারী দুষ্ট প্রাণী রয়েছে, যারা মানুষের অভ্যন্তরের মাংস দ্বারা নিজেকে পুষ্ট করে; যে কিনা পশুসমূহের মধ্যে নিরপরাধ পশু দ্বারা নিজেকে উত্তমভাবে পরিপুষ্ট করে; যে হত্যার অযোগ্য গোরুর দুগ্ধকে হরণ করে-নষ্ট করে-দূষিত করে।
নিরুক্তে [ ২।৭ ] অধ্বর শব্দের অর্থ বলা হয়েছে "অধ্বর ইতি যজ্ঞনাম ধ্বরতিহিংসাকর্মা তৎপ্রতিষেধ " অধ্বর = হিংসারহিত কর্ম অর্থাৎ যাতে কোনো রূপ হত্যা হয় না।
রাজসূয়ং বাজপেয়মগ্নিষ্টোমস্তদধ্বরঃ। অর্কাশ্বমেধাবুচ্ছিষ্ট জীবর্বহিভমদিন্তম।।
রাজসূয়, বাজপেয়, অগ্নিষ্টোম এইসব যজ্ঞ অধ্বর অর্থাৎ হিংসারহিত। অর্ক এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রভুর মধ্যে স্থিত, যা জীবের বৃদ্ধিকারী এবং অত্যন্ত হর্ষদায়ক।
অগ্নে যঃ যজ্ঞমধ্বরং বিশ্বত বিশ্বতঃ পরিভূরসি। স ইদ্দেবেষু গচ্ছতি।।
হে পরমেশ্বর! তুমি অধ্বর অর্থাৎ হিংসারহিত যজ্ঞকে সর্বত্র ব্যাপক হয়ে সব প্রকারে পালনকারী। এই হিংসারহিত যজ্ঞে বিদ্বান লোক সুখ প্রাপ্ত করে। যজ্ঞের জন্য অধ্বর [হিংসারহিত] শব্দের প্রয়োগ ঋগ্বেদ ১।১।৮, ১।১৪।২১, ১।১৯।১, ১।২৮।১, ৩।২১।১ এরূপ বহু স্থলে এসেছে।
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কর্তৃক সর্বপ্রথম ব্যাকরণ ও বেদাঙ্গ অনুসন্ধান করে বেদের বিশুদ্ধ ভাষ্য রচনা ও 'গোমেধ', 'অশ্বমেধ', 'নরমেধ' প্রভৃতি যজ্ঞের প্রকৃতরূপ উদ্ঘাটন ও পরবর্তী সকল বৈদিক ভাষ্যকারগণ কর্তৃক তাঁর অনুবাদ অনুসরণের ফলে এখন বেদ দেখিয়ে বলি সিদ্ধ করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বেদে বলি সিদ্ধ করতে গেলে তার সাথে গোহত্যা ও অশ্লীলতার ও উদ্ভব ঘটে।