"ইত্থং মাতা বিদ্যা চক্রং স্বগুরুঃ স্বয়ঞ্চেতি"।
"পঞ্চানামপি ভেদাভাবো মন্ত্রস্য কৌলিকার্থোহয়ম্।।
অর্থাৎ : প্রমাতা (শিব), ইষ্টদেবতা, তাঁর চক্র (মন্ত্র ইত্যাদি) গুরু এবং সাধক এই পাঁচের ভেদাভাব অর্থাৎ অভেদই মন্ত্রের গূঢ়ার্থ।
মন্ত্রজপে সিদ্ধিলাভ করতে হলে মন্ত্রচৈতন্য করে এবং মস্ত্রার্থ পরিজ্ঞাত হয়েই যথাবিধি জপ করতে হয়। কেননা, মন্ত্রসিদ্ধি লাভ করতে হলে, মন্ত্র যে অক্ষরে, যে ভাবে, যে ছন্দোবন্ধে গ্রথিত আছে, তা সেভাবে জপ করতে হয়। তবেই মন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করা যাবে। তাই কুলার্ণবতন্ত্রে বলা হয়েছে–
মনোহন্যত্র শিবোহন্যত্র শক্তিরন্যত্র মারুতঃ।
ন সিধ্যন্তি বরারোহে কল্পকোটিশতৈরপি।। (কুলার্ণবতন্ত্র)
অর্থাৎ : মন্ত্রজপকালে মন, পরম-শিব, শক্তি এবং বায়ু পৃথক পৃথক স্থানে থাকিলে অর্থাৎ ইহাদিগের একত্র সংযোগ না হইলে শতকল্পেও মন্ত্রসিদ্ধি হয় না। সরস্বতীতন্ত্রের ষষ্ঠ পটলে জগৎগুরু যোগেশ্বর মহাদেব বলছেন–
অন্ধকারগৃহে যদ্বৎ ন কিঞ্চিৎ প্রতিভাসতে।
দীপনীরহিতো মন্ত্রস্তথৈব পরিকীর্তিতঃ।।- (সরস্বতীতন্ত্র-৬/৪)
অর্থাৎ : আলোহীন অন্ধকাাচ্ছন্ন গৃহমধ্যে যেমন কোন বস্তুই প্রতিভাসিত হয় না বা দেখা যায় না, সেইরূপ দীপনীহীন মন্ত্রও তত্ত্বপ্রকাশনে সমর্থ হয় না ফলে মন্ত্রজপে কোন ফল হয় না, এমত কথিত হইয়াছে।
এখন মন্ত্রার্থ কী, তা জানা যাক। তন্ত্রমতে মন্ত্র ও দেবতার অভেদজ্ঞানই মন্ত্রার্থ। মন্ত্রার্থ মানে শব্দার্থ নয়। মন্ত্রের ভাবার্থ উপলব্ধি করা শিখতে হবে, এবং তা সাধনসাপেক্ষ। মন্ত্রার্থ প্রসঙ্গে রুদ্রযামলে বলা হয়েছে–
মন্ত্রার্থ-দেবতারূপ-চিন্তনং পরমেশ্বরি।
বাচ্যবাচকভাবেন অভেদো মন্ত্রদেবয়োঃ।।- (রুদ্রযামল)
অর্থাৎ : ইষ্টদেবতার মূর্তি চিন্তা করিলে অর্থাৎ দেবতার শরীর ও মন্ত্র অভিন্ন এইরূপ ভাবিলে মন্ত্রার্থ ভাবনা হয়। দেবতার রূপচিন্তনই মন্ত্রার্থ। মন্ত্র ও দেবতা বাচ্য-বাচক ভাবে অভিন্ন।
সকল মন্ত্রেই দুইটি শক্তি নিহিত থাকে। একটি বাচ্য শক্তি, অপরটি বাচক শক্তি। মন্ত্রের প্রতিপাদ্য দেবতাই মন্ত্রনিষ্ঠ বাচ্য শক্তি এবং মন্ত্রময়ী দেবতাই বাচক শক্তি। বীজ যেরূপ ফলের অন্তরেই নিহিত থাকে, বাচ্য শক্তিও সেইরূপ বাচক শক্তির অন্তর্নিহিত। ফলের বহিরাবরণ ভেদ না করিলে অভ্যন্তরের বীজকে লক্ষ্য করা যায় না, সেইভাবে বাচক শক্তির আরাধনা না করিলে বাচ্য শক্তির স্বরূপ জানিতে পারা যায় না। বাচ্য শক্তির সামর্থ্যে মন্ত্র জীবিত থাকে এবং বাচক শক্তির সামর্থ্যে রক্ষিত হয়। সুতরাং এই উভয় শক্তির একটিকেও বাদ দিবার উপায় নাই। একটিকে বাদ দিলেই মন্ত্র নিবীর্য হইয়া যাইবে। মন্ত্রকে অক্ষর-রূপে মনে না করিবার আরও হেতু আছে। অক্ষরাত্মক মন্ত্র শব্দব্রহ্মের প্রতীক মাত্র----অক্ষরজ্ঞান-রূপ সংবিদের অধিষ্ঠাতা স্বয়ং মহেশ্বর। শব্দ এবং অক্ষরসমূহ তাঁহারই শক্তি। তাঁহাতে অনন্ত শক্তি-বৈচিত্র্যের উদয় এবং লয় হইতেছে। আর অক্ষরসমূহের মধ্যে তদীয় শক্তিত্ব-রূপ একই সাধারণ ধর্ম আছে বলিয়া প্রতীক-রূপ অক্ষরসমূহেরও আত্যন্তিক ভেদ নাই। এই দৃষ্টিতে বিচার করিলে বোঝা যায়– প্রণবাদি সকল বীজ মন্ত্রই তাঁহার বাচক। শক্তি ও শক্তিমানের মধ্যে আত্যন্তিক ভেদ স্বীকৃত হয় নাই।’
মন্ত্রে দেবতা মন্ত্রবাচ্যা এবং মন্ত্র দেবতার বাচক, সুতরাং বাচ্য বিজ্ঞাত হলে বাচক প্রসন্ন হন। এভাবে মন্ত্রের অর্থ পরিজ্ঞাত হয়ে জপ না করলে মন্ত্রসিদ্ধি হয় না। তাই সবারই আপন আপন ইষ্টদেবতার, আপন আপন মন্ত্রের অর্থজ্ঞান থাকা আবশ্যক। শাস্ত্রে মন্ত্রার্থজ্ঞানের এক উৎকৃষ্ট উপায় লিখিত আছে। সে উপায়ে সবাই সকল প্রকার মন্ত্রার্থ পরিজ্ঞাত হতে পারেন। তার দ্বারা মন্ত্রের অর্থ আপনিই সাধক-হৃদয়ে প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
গুরুর স্মরণাপন্ন হয়ে ওটা জাগাতে হবে আগেভাগে। না হলে পুজো, হোম সব হবে, কিন্তু বীজের শরীরময় স্পন্দনখানি কখনও বোঝা যাবে না।