অর্থাৎ, দেবী দুর্গা ব্রহ্মবিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী; জীবদশা নাশ করাই ব্রহ্মবিদ্যার স্বভাব; এইজন্য পশুর পশুত্ব নাশের ইচ্ছায় পশুবলি দেবীর প্রিয়; অর্থাৎ বলিদানে নিহত পশুকে দেবী মুক্তি দান করেন, তাকে আর পশু জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। মানুষ তো সাধনার দ্বারা মুক্তিলাভে অধিকারী হয়, কিন্তু পশুর সে ক্ষমতা নেই। পূজক দেবীর পূজায় পশুকে বলি দিলে দেবী তাকে মুক্তি দিতে পারেন, এইজন্য পশুবলি দেবীর প্রিয়। আপাতত মনে হতে পারে, বলিদানের পশুর দেহের প্রতি অত্যাচার করা হয়; কিন্তু শাস্ত্রমতে, বলির দ্বারা প্রকৃতপক্ষে পশুর আত্মার উপকারই করা হয়। এই কারণেই দেবী ভাগবতে 'ন হিংসা পশুজা তত্র' এবং কালিকাপুরাণে ‘তস্মাদ যজ্ঞে বধোহবধঃ' অর্থাৎ দেবীপূজায় পশু হিংসা হিংসা নয় ইত্যাদি উক্তি করা হয়েছে। দেবীপূজায় পশুবধ বৈধহিংসা। অবৈধহিংসা সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য, কিন্তু দয়াপ্রকাশ করে বৈধহিংসা পরিত্যাগ করা মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ, —শাস্ত্রকারগণের এইরকমই অভিমত।
শাস্ত্র বলছে
"যজ্ঞার্থে পশবঃ সৃষ্ট্বা স্বয়মেব স্বয়ম্ভুবা।
অতস্ত্বাং ঘাতয়ামাদ্য তস্মাদ্ যজ্ঞে বধোহবধ:।।
ঐং হ্রীং শ্রীং ইতি মন্ত্রেণ তং বলিং কামরূপিণম্।।
(কালিকাপুরাণ... ৫৫ অধ্যায় ১০নং শ্লোক)
তরজমা- ঈশ্বর স্বয়ং যজ্ঞের জন্য সকল প্রকার পশুর সৃষ্টি করেছেন, এই জন্য আমি তোমাকে হত্যা করি, তাই যজ্ঞে পশুহত্যা হিংসার মধ্যে গণ্য হয় না।" (বধোহবধ: শব্দের অর্থ বধ হয়েও অবধ যাহা)। তারপর (ঔঁ) ঐং হ্রীং শ্রীং মন্ত্রে বলির পশুকে কামরূপ কল্পনা করে এক আঘাতে বলিচ্ছেদ করতে হবে।।
বলিদানং ততঃ পশ্চাৎ কুর্য্যাদ্দেব্যাঃ প্রমোদকম্ ।
মোদকৈর্গজবক্ত্ঞ্চ হবিষা তোষয়েদ্রবিম্ ।।
তৌর্যত্রিকৈশ্চ নিয়মৈঃ শঙ্করং তোষয়েদ্ধরিম্ ।
চণ্ডিকাং বলিদানেন তোষয়েৎ সাধকঃ সদা ।।
পক্ষিণঃকচ্ছপা গ্রাহাশ্চাগলাচ বরাহকাঃ।
মহিষো গোধিকাশীষা তথা নববিধা মৃগাঃ ।।
চামরঃ কৃষ্ণসারশ্চ শশঃ পংচাননস্তথা মৎস্যাঃ।
স্বগাত্ররুধিরাধা বলয়া মতাঃ।। (কালিকা পুরাণ, ৫৫ অধ্যায়/ ১-৪ শ্লোক)
অর্থাৎ: তারপর, দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দাও। কারণ, গণপতি মোদকে, বিষ্ণু ঘি দিয়ে, শিব সংগীতে ও আমাদের আদিশক্তি/পরাশক্তি শ্রীশ্রী চণ্ডী বলিতে তুষ্ট হন। পাখি, কচ্ছপ, কুমির, নব শাকাহারী প্রাণী -বুনো শুয়োর, ছাগল, মোষ, ঘোড়া, খড়গোঁজা, হরিণ, কৃষ্ণসার হরিণ, মাছ, নিজ রক্ত এগুলোই বলি হিসেবে দেওয়া সম্ভব।
বাঘ, সিংহ এগুলি ক্ষত্রিয়দের বলিদানের অনুমতি আছে কিন্তু ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে নিষেধ।কালিকা পুরাণ ৬৭নং অধ্যায় (রুধীর অধ্যায়) ৪৮ থেকে ৫১নং।।
সিংহংব্যাঘ্রং নরং চাপি স্বগাত্ররুধীরং তথা।।
ন দদ্যাৎ ব্রাহ্মণো মদ্যংমহাদেব্যৈ কদাচন।
সিংহংব্যঘ্রন্নরং দত্বা ব্রাহ্মণো নরক ব্রজেৎ।।
ইহাপি স্যাৎ স হীনায়ু: সুখসৌভাগ্যবর্জিত:।
স্বগাত্ররুধীরং দদ্যাচ্চাত্মবধ্যামবাপ্নুয়াৎ।।
মদ্যংদত্ত্বা ব্রাহ্মণস্তু ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।
অর্থাৎ: ব্রাহ্মণ, দেবীর নিকট সিংহ, বাঘ, মানুষ, নিজের গাত্রের রক্ত অথবা মদ কখনই বলি প্রদান করিবে না।
ব্রাহ্মণ ব্যক্তি- সিংহ, বাঘ এবং নরবলি প্রদান করিয়া নরকে গমন করে এবং ইহ লোকে কম আয়ু এবং সুখ-সৌভাগ্যহীন হয়।
ব্রাহ্মণ নিজের গাত্রের রক্ত দান করিয়া আত্মহত্যার পাপ প্রাপ্ত হয়, আর মদ দান করিয়া ব্রাহ্মণ্য হইতে চ্যুত হয়।
আর বলি পুরুষ প্রাণীর হবে। নারীবলি নিষেধ। ওই অধ্যায়ের ৯৩ নং এ আছে
পশুনাংপক্ষিণাং বাপি নরাণাং চ বিশেষত:।।
স্ত্রিয়ং ন দদ্যাৎ তু বলীন্ দত্ত্বা নরকমাপ্নয়াৎ।
অর্থাৎ:- পশু-স্ত্রী, মেয়ে পাখি সর্বাগ্রে মানুষ-স্ত্রীকে কখনই বলি প্রদান করিবে না। নারী বলিদান করিলে কর্তা নরকপ্রাপ্ত হয়।
আর কেউকেউ বলে মোষ ছাগল না দিয়ে নিজের বাড়ির লোককে বলি দাও। আজ্ঞে, সেটাও নিষেধ। ওই অধ্যায়ের ১০৩নং এ আছে:
স্বপুত্রং ভ্রাতরং বাপি পিতরং চাবিরোধিনং।
বিট্-পতিং চ ন দদ্যাত্তুভাগিনেয়ং চ মাতুলম্ ।।
অর্থাৎ:- নিজের ছেলে, ভাই, বিরোধকারী হইলেও বাবা, জামাতা, ভাগ্নে এবং মামা ইহাদিগকে বলি প্রদান করিবে না।
কালিকা পুরাণ ৬৭নং অধ্যায় (রুধীর অধ্যায়)৯৩ নং এ আছে
পশুনাংপক্ষিণাং বাপি নরাণাং চ বিশেষত:।।
স্ত্রিয়ং ন দদ্যাৎ তু বলীন্ দত্ত্বা নরকমাপ্নয়াৎ।
অর্থাৎ:- পশু-স্ত্রী, মেয়ে পাখি সর্বাগ্রে মানুষ-স্ত্রীকে কখনই বলি প্রদান করিবে না। নারী বলিদান করিলে কর্তা নরকপ্রাপ্ত হয়।