কশ্যপ ঋষি: এক মহান শক্তিশালী সপ্তর্ষি
সনাতন গ্রন্থ অনুসারে, কশ্যপ ঋষি হলেন সপ্তর্ষিদের একজন এবং তাই তাঁকে আশ্চর্যজনক ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হয়।
ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির প্রথম যুগে ছিলেন এক মহান ঋষি — কশ্যপ মুনি, যিনি ব্রহ্মার মানসপুত্র মহর্ষি মারিচি এবং তাঁর স্ত্রী কালের পুত্র।
ঋষি কশ্যপ, যিনি কশ্যপ ঋষি নামেও পরিচিত, একজন প্রাচীন বৈদিক ঋষি। তিনি সবচেয়ে সম্মানিত এবং সুপরিচিত হিন্দু ঋষিদের একজন। এই কারণেই তিনি সপ্তর্ষি নামক সাতজন শ্রেষ্ঠ ঋষির দলের অন্তর্ভুক্ত।
বৈদিক-পরবর্তী কিছু গ্রন্থে বলা হয়েছে যে সপ্তর্ষিদের মধ্যে কিছু হলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা ভগবান ব্রহ্মার মনস্পুত্র (মানসপুত্র)।
ঋষি কশ্যপ ছাড়াও অন্যান্য সপ্তর্ষি ছিলেন গৌতম, অত্রি, ভরদ্বাজ, বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ এবং জমদগ্নি।
বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে, ঋষি কশ্যপ হলেন অন্যান্য ছয় সপ্তর্ষির সাথে উর্সা প্রধান নক্ষত্রপুঞ্জের একটি নক্ষত্র।
কশ্যপ আসলে কচ্ছপ মানে কিন্তু তিনি কশ্যপ অবতার নন। বরং তিনি কশ্যপ প্রজাপতি নামে পরিচিত। একজন প্রজাপতি একটি অত্যন্ত উচ্চ পদ। উদাহরণস্বরূপ, আপনি অবশ্যই দক্ষ প্রজাপতি সম্পর্কে শুনেছেন।
ব্যক্তিত্ব:- তিনি একজন শক্তিশালী ঋষি এবং আশ্চর্যজনক ক্ষমতা সম্পন্ন ঋষি, তবুও তিনি অত্যন্ত নম্র এবং সহায়ক। তাঁর ক্ষমতা দিয়ে, তিনি অবিশ্বাস্য বর দিতে পারেন যেমনটি তিনি তাঁর দুই স্ত্রীর ক্ষেত্রে করেছিলেন।
ঋষি কশ্যপ অনেক বৈদিক গ্রন্থ, সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ এবং মহাকাব্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর মধ্যে রয়েছে বেদ, পুরাণ, মহাভারত, রামায়ণ এবং উপনিষদ।
তাঁর তপস্যা ও বুদ্ধির প্রভাবে তিনি পরবর্তীতে হলেন সমগ্র জীবজগতের জনক!
যাঁর সন্তানরা দেবতা, অসুর, নাগ, দানব জাতিরও পূর্বপুরুষ!
কশ্যপ মুনি বিবাহ করেছিলেন দক্ষ প্রজাপতির তেরোজন কন্যাকে —
আর সেই 13 স্ত্রী থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন জীবগোষ্ঠী।
🌸 অদিতি
অদিতি ছিলেন প্রজাপতি দক্ষের কন্যা।অদিতি ছিলেন দেবমাতৃকা।তাঁর সন্তানরা হলো আদিত্যগণ।
আদিত্যের মধ্যে প্রধান দেবতা ইন্দ্র।এছাড়া সূর্য, বরুণ, মিত্র প্রভৃতি।অদিতি অসীম দয়ার প্রতীক।তাঁর গর্ভে জন্মানো দেবতারা সর্বদা ধর্মরক্ষার জন্য সংগ্রাম করেন।অদিতি ভগবান বিষ্ণুরও ভক্ত ছিলেন।তিনি দেবগণের মা হিসেবে পূজিতা হন।
🌸দিতি
দিতি ছিলেন অসুরদের জননী।তিনি অদিতির সহোদরা।তাঁর সন্তানরাই হলো অসুরগণ।হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু হল তাঁরই দুই মহাপুত্র।হিরণ্যকশিপু ছিলেন প্রহ্লাদের পিতা।তাই প্রহ্লাদও কশ্যপের পৌত্র।
দিতির গর্ভ থেকে বহু অসুর জন্ম নেয়।দিতি একবার কশ্যপ এর তপস্যা ভঙ্গ করে সন্তান হওয়ার আশীর্বাদ চান কিন্তু তখন ছিল সন্ধ্যা তাই তিনি বলেন এখন আশীর্বাদ দিলে তোমার অসুর পুত্র জন্মাবে। দিতি বলল তাই হোক।কশ্যপ রাজি হলেও তপস্যা ভঙ্গ হওয়ায় তার আশীর্বাদে অসুর পুত্র জন্মায়।
🌸দনু
দনু ছিলেন দক্ষকন্যা।তাঁর সন্তানরা হলো দানবগণ।
ভৃশপর্ণ, একচক্র, শম্ভর প্রভৃতি দানব দনুর সন্তান।
দনুবংশীয় দানবরা দেবতাদের সঙ্গে চিরশত্রু।তারা প্রায়ই স্বর্গ আক্রমণ করত।পুরাণে দানবরা শক্তিশালী কিন্তু অধার্মিক বলে বর্ণিত।দনু থেকে "দানব" শব্দের উৎপত্তি।দনু সন্তানদেরকে বিশাল আকারের, মহাবলশালী বলা হয়।মহাভারতে দনুবংশীয় যোদ্ধাদের উল্লেখ আছে।তাই দনু হলেন অন্ধকারশক্তির উৎস।
🌸কদ্রু
কদ্রু ছিলেন নাগমাতা।তিনি অসংখ্য নাগের জন্ম দেন।
বাসুকি, তক্ষকপ্রভৃতি তাঁর সন্তান।কদ্রু একবার বিনতার সঙ্গে ঘোড়ার লেজের রং নিয়ে বাজি ধরেন।
তিনি প্রতারণা করে জিতেছিলেন।এতে বিনতা দাসী হয়ে যান।কদ্রুর সন্তানরা সর্পরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
নাগদের আবাস পাতাল ।কদ্রু ছিলেন নাগজাতির জননী।
🌸বিনতা
বিনতা ছিলেন গরুড় ও অরুণের জননী।
তিনি কদ্রুর বোন।একবার ভুলবশত তিনি গর্ভফল(ডিম) অকালেই ভেঙে ফেলেন।
তখন জন্ম হয় অরুণের ।পরে তিনি গরুড়কে জন্ম দেন।গরুড় হলো দেবপক্ষী ও বিষ্ণুর বাহন।
গরুড় নাগদের শত্রু।তাই কদ্রুর সন্তানদের সঙ্গে শত্রুতা শুরু হয়।বিনতা কদ্রুর প্রতারণায় দাসত্বভোগ করেন।
পরে গরুড় মায়ের মুক্তি ঘটান।
🌸তাম্রা
তাম্রা ছিলেন পক্ষীদের জননী।তাঁর সন্তানরা হলো বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।শকুন, বাজ, ময়ূর প্রভৃতি।তিনি আকাশচর প্রাণীদের জন্ম দেন।
তাম্রার সন্তানরা প্রকৃতির ভারসাম্যে ভূমিকা রাখে।
তাঁর বংশধরদের মধ্যে অনেক পক্ষীর উল্লেখ পুরাণে আছে।তাম্রা থেকে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির পাখি প্রসারিত।
তাঁর বংশধরদের মধ্যে শকুনরা প্রায়ই অশুভ সংকেত হিসেবে ধরা হয়।তাই তাম্রা আকাশবাসীদের মা।
🌸সুরভি
সুরভি ছিলেন ধেনুমাতা।তিনি গরু ও গোসম্পদের জননী।গাভীকে "কামধেনু" বলা হয়।
কামধেনু অসীম দুধ ও সম্পদ দিতে সক্ষম।
সুরভি থেকে পৃথিবীতে গোসম্পদ আসে।
গরুকে হিন্দু ধর্মে পবিত্র বলা হয়।সুরভি দেবলোকেও পূজিত হয়তাঁর দুধ থেকে অমৃত সৃষ্ট হয় বলে বলা হয়।
তিনি সমৃদ্ধির প্রতীক।তাই তাঁকে সর্বত্র পূজা করা হয়।
🌸 ইলা
ইলা বৃক্ষলতা ও উদ্ভিদের জননী।তাঁর গর্ভে জন্ম নিয়েছে গাছপালা।ইলা থেকে খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়।তিনি পৃথিবীর জীবনধারণের মূল উৎস।
তিনি কৃষির প্রতীক।উদ্ভিদবিনাশ হলে মানবসভ্যতা টিকত না।তাই ইলা জীবনরক্ষক।
পুরাণে তাঁকে বনদেবী বলা হয়।তিনি প্রকৃতির মূল প্রতীক।
🌸 মুনি
মুনি থেকে জন্ম নেয় অপ্সরারা।অপ্সরারা দেবলোকের নৃত্যশিল্পী।তাঁরা দেবতাদের আনন্দ দিতেন।
মুনি ছিলেন সৌন্দর্যের প্রতীক।অপ্সরারা প্রায়ই ঋষিদের তপস্যা ভঙ্গ করতেন।যেমন মেনকা, উর্বশী, রম্ভা।এরা সবাই মুনির কন্যা।মুনি থেকে জন্মানো অপ্সরারা দেবলোকের শোভা।তাঁদের রূপগুণ অদ্বিতীয়।তাই মুনি স্বর্গীয় সৌন্দর্যের জননী।
🌸 অরিষ্টা
অরিষ্টা গন্ধর্বদের জননী।গন্ধর্বরা দেবলোকের গায়ক।
তাঁরা সঙ্গীত ও কাব্যের দেবতা।অরিষ্টার সন্তানরা স্বর্গের সঙ্গীতজ্ঞ।তারা গান গেয়ে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে।
গন্ধর্বরা স্বর্গীয় অনুষ্ঠানের অংশ।তাঁরা সৌন্দর্য ও সঙ্গীতের প্রতীক।অরিষ্টা সঙ্গীতময় শক্তির উৎস।
🌸 ক্রোধবশা
ক্রোধবশা ছিলেন রাক্ষস ও পিশাচদের জননী।
তাঁর সন্তানরা ভয়ঙ্কর স্বভাবের।পিশাচরা অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়।রাক্ষসরা মানুষের শত্রু।ক্রোধবশার সন্তানরা ধ্বংসাত্মক।তাঁরা ভয়ের প্রতীক।পিশাচরা মৃতদেহ ভক্ষণ করে।রাক্ষসরা দেবতা ও মানবের বিরোধী।
ক্রোধবশা অশুভ শক্তির প্রতীক।তাঁর নামেই ক্রোধের প্রকাশ।
🌸 খাসা
খাসা ছিলেন যক্ষ ও রাক্ষস জননী।
যক্ষরা ধনরত্নরক্ষক।তাঁরা কুবেরের অনুসারী।
খাসার সন্তানরা দুই দলে বিভক্ত।একদল শুভ ( যক্ষ)।
অপরদল অশুভ (রাক্ষস)।যক্ষরা কল্পবৃক্ষ ও ধন রক্ষা করে।
রাক্ষসরা মানববিরোধী।খাসা দুই বিপরীত শক্তির উৎস।
কশ্যপ ঋষির বহু স্ত্রী ছিলেন।
প্রত্যেক স্ত্রী এক-একটি জাতির জন্ম দেন।
দেবতা, দানব, গন্ধর্ব, অপ্সরা, যক্ষ, রাক্ষস।
আবার পশু-পাখি, গরু, গাছপালা।
সবকিছু তাঁর বংশ থেকে উৎপন্ন।
এজন্য তাঁকে সমস্ত জীবের পিতা বলা হয়।
পুরাণে কশ্যপের গুরুত্ব অপরিসীম।
দেব-অসুর যুদ্ধের মূল সূচনা তাঁর পরিবার থেকেই।
অদিতি-দিতির দ্বন্দ্বই দেব-অসুর সংঘাত।
কদ্রু-বিনতার বিরোধ নাগ-গরুড় সংঘাত।
তাই কশ্যপের পরিবারই বিশ্বসংসারের প্রতিচ্ছবি।
প্রতিটি স্ত্রী এক একটি শক্তির প্রতীক।
অদিতি – ধর্ম ও আলো।
দিতি – অধর্ম ও অন্ধকার।
দনু – দানবীয় শক্তি।
কদ্রু – সর্পশক্তি।
বিনতা – গরুড়শক্তি।
তাম্রা – পক্ষীশক্তি।
সুরভি – ধেনুশক্তি।
ইলা – বৃক্ষশক্তি।
মুনি – সৌন্দর্যশক্তি।
অরিষ্টা – সঙ্গীতশক্তি।
ক্রোধবশা – অশুভ শক্তি।
খাসা – দ্বৈতশক্তি।
তাই কশ্যপই বিশ্বসৃষ্টি রূপে পূজিত।ঋগ্বেদেও কশ্যপের উল্লেখ আছে।তিনি তপস্যাশক্তিতে সমৃদ্ধ ছিলেন।
তাঁর আশ্রমে দেবতা পর্যন্ত আসতেন।তিনি মহাদেব ও বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন।তিনি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষক।
কশ্যপ পরিবার মূলত প্রকৃতির চক্র।দেবতা – আলো ও ন্যায়।অসুর – অন্ধকার ও অন্যায়।নাগ – ভূগর্ভশক্তি।
গরুড় – আকাশশক্তি।গরু – সম্পদশক্তি।বৃক্ষ – খাদ্যশক্তি।অপ্সরা – আনন্দশক্তি।গন্ধর্ব – সঙ্গীতশক্তি।
যক্ষ – সম্পদরক্ষা।রাক্ষস – ধ্বংসশক্তি।
তাই কশ্যপের স্ত্রীগণ বিশ্বতত্ত্বের প্রতীক।এটি প্রকৃতির বৈচিত্র্যের ব্যাখ্যা।প্রতিটি শক্তি অপরিহার্য।
বিষ্ণু পুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে বর্ণিত আছে —
“কশ্যপো ভগবান ঋষি সর্বপ্রাণীনাম পিতা।”
অর্থাৎ, “কশ্যপ মুনি হলেন সমস্ত প্রাণীর পিতা।”
তিনি প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষাকারী এক যোগী,
যিনি নিজ বংশধরদের মাধ্যমে বিশ্বে আলো-অন্ধকার, শুভ-অশুভ, সব শক্তিকেই একত্রে স্থাপন করেছিলেন।
কশ্যপ মুনির কাহিনি আমাদের শেখায় —এই বিশ্বে আলো ও অন্ধকার, ভালো ও মন্দ — দুটোই সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
যিনি এই দুইয়ের সমন্বয় বোঝেন, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী---কশ্যপ ছাড়া সৃষ্টি অসম্পূর্ণ।তাঁর নামে কশ্যপ গোত্র গঠিত হয়েছে।
আজও বহু হিন্দু পরিবার কশ্যপ গোত্র ধারণ করে।কশ্যপ ছিলেন আদি ঋষিদের অন্যতম। তাই তাঁর স্থান অনন্য।