বর্ধমান জেলায় তিনটি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি হল কোগ্রামে মা মঙ্গলচন্ডীর মন্দির। অজয় এবং তার শাখানদী কুনুরের সঙ্গমস্থলে বহু প্রাচীন জনপদ কোগ্রাম। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল উজানি, সেজন্য এই মন্দিরকে উজানি সতীপীঠও বলা হয়। উজানির উল্লেখ পাওয়া যায় কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল আর মনসামঙ্গল কাব্যে। একসময়ের বর্ধিষ্ণু জনপদ উজানি প্রাচীর ঘেরা বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। চন্ডীমঙ্গলের চরিত্র ধনপতি সওদাগর আর মনসামঙ্গলের বেহুলা, এঁদের বাসস্থান ছিল এই উজানি।
নৌবাণিজ্যে পুর্ব বর্ধমানের আদিসপ্তগ্রাম বন্দরের গৌরবের সঙ্গে এই অঞ্চলের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। অজয় নদের মাধ্যমে নদীবাণিজ্যে যোগাযোগ ছিল আদিসপ্তগ্রাম বন্দরের। আন্দাজ করা যায় কোন এক দূর অতীতে ধনবান বণিকদের বাসভুমি ছিল এই এলাকা, যার প্রতিফলন ঘটেছিল চন্ডীমঙ্গল কাব্যে। ধনপতি সদাগরের আরাধ্যা চন্ডীর সঙ্গে, এই দেবী মঙ্গলচন্ডীর কোন ইতিহাস হয়ত একাকার হয়ে আছে। আজ অবশ্য সেই জনপদের কোন চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না। অজয়ের তীরে কোগ্রাম নিতান্তই অবহেলিত, অতিসাধারণ একটি গ্রাম, মন্দিরটি ছাড়া যার আর কোন তাৎপর্যই নেই।
একটি পাঁচিল ঘেরা অত্যন্ত সাদামাটা, দালান ঘরানার মন্দির। বাইরে থেকে প্রথম দেখায় কোন সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ী বলে ভুল হতে পারে। মন্দিরে ঢোকার লোহার গেটের উপর বোগেনভেলিয়ার ঝাড়। ভিতরে ঢুকেই বাঁহাতে মন্দির। দেখেই বোঝা যায় এ কোন পুরানো স্থাপত্য নয়। শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ হিসেবে এর ইতিহাস অতি প্রাচীন হলেও আধুনিক মন্দিরটি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে না। আমার ধারণায় সতীপীঠ হিসেবে মা মঙ্গলচন্ডীর বিগ্রহ এই জায়গায় বহুদিন থেকে পূজিত হলেও অনান্য সতীপীঠের মত কোন রাজা বা ধনী জমিদারের অর্থানুকূল্য পায়নি। ফলে সেভাবে কোন জমকালো মন্দিরও গড়ে ওঠেনি। সাধারণ ভক্তদের দানে যেটুকু সম্ভব সেটুকুই হয়েছে।
এখানে দেবী মঙ্গলচন্ডী রূপে পূজিতা, ভৈরব কপিলাম্বর। কথিত আছে এখানে সতীর ডান হাতের কব্জী পড়েছিল।
বিগ্রহ কষ্টিপাথরের তৈরী। একটি কাঠের জলচৌকির উপর বসানো কাঠের সিংহাসনে দেবীর অধিষ্ঠান। জলচৌকি আর সিংহাসন দুটিতেই কাঠের উপর লতাপাতার কাজ, সোনালী রং করা। দেবী দশভূজা, দূর্গার অবতার। তবে ফুল মালায় ঢাকা থাকার জন্য শুধু মুখমন্ডল দৃশ্যমান থাকে। ত্রিনয়নী দেবী মুর্তি। চোখগুলি সম্ভবতঃ সোনার। মাথায় রুপোর মুকুট। বিগ্রহে প্রাচীনত্বের ছাপ স্পষ্ট। ঠিক পাশেই মার্বেলের বেদীর উপর একটি ছোট কাঠের খাট, শয়ান দেওয়ার জন্য। তার পাশে ভৈরব কপিলাম্বরের লিঙ্গ।
দেবীর নিত্যপূজায় অন্নভোগ দেওয়া হয়। এছাড়া এখানে নিয়মিত মৎস্যভোগ দেওয়ার রীতি আছে। দেবী যেহেতু দূর্গার অবতার রূপে পুজিতা, আশ্বিনমাসে দূর্গাপূজার সমস্ত রীতি মেনেই মহা ধুমধামে চারদিন ধরে পুজা হয়। পূজার চারদিনই বলি হয়, তবে শুধুমাত্র নবমীর দিন পাঁঠা বলি হয়। বাকি সপ্তমী, অষ্টমী আর দশমীর দিন চালকুমড়ো, আখ ইত্যাদি বলি হয়। কালীপূজার দিন দেবী মঙ্গলচন্ডী রূপে পূজিতা হন।
মন্দির খোলার সময় সকাল আটটা। দুপুরের ভোগের পর মন্দির বন্ধ হয় দেড়টার সময়। আবার মন্দিরের দরজা খোলে বিকেল চারটেয়। অবশ্য বন্ধ থাকলেও দর্শনের কোন অসুবিধা হয় না, শুধু পুজো দিতে পারবেন না। পুজোর সামগ্রী নিয়ে আসাই ভালো কারণ আশেপাশে কোন দোকান পাবেন না।
অত্যন্ত শান্ত, নির্জন পরিবেশে মন্দিরটি। কোন ভিড় হৈ হট্টোগোল, পান্ডা, ভিখারীদের উপদ্রব, কিছুই নেই। কোন জোর জুলুম নেই, পুজো দিতে চাইলে নিজের মত করে পুজো দেওয়া যায়।
মন্দিরের ঠিক পিছন দিক দিয়ে অজয় নদ বয়ে যাচ্ছে। অজয়ের ধারে গেলেও খুব ভালো লাগবে। পিছনদিকেই ঘাটের সিঁড়ি নেমে গেছে অজয়ের বুকে। এখানে অজয় বিরাট চওড়া। আমি যখন গিয়েছিলাম, ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময়, তখন জল প্রায় নেই। নদীর বুকে ধুধু করছে বালির চরা, মাঝে মাঝে জলের রূপালী রেখা।
বকেশ্বর শক্তিপীঠ :- পশ্চিমবঙ্গের বক্রেশ্বর শক্তিপীঠ বীরভূম জেলার পাপহরা নদীর তীরে অবস্থিত। দেবী সতীর ভ্রূযুগলের মধ্যবর্তী অংশ বা তার মন এই অঞ্চলে পতিত হয়েছিল । কথিত আছে সত্যযুগে লক্ষ্মী ও নারায়ণএর বিয়েতে ইন্দ্র সুব্রত মুনিকে অপমান করেন।অপমান এ রাগে ঋষির দেহ আট বাঁকে বেঁকে যায়। তিনি অষ্টাবক্র ঋষি নামে পরিচিত হন। মহামুনি অষ্টাবক্র এখানে শিবের তপস্যা করেন ও পাপহরা নদীতে স্নানের পর পাপমুক্ত হন।তার নামে তাই মহাদেবের নাম এখানে বক্রেশ্বর বা বক্রনাথ। এটি একটি মহাশক্তি পীঠ হিসেবে বিবেচিত। বীরভূমের সদর শহর সিউড়ী থেকে 20 কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই বক্রেশ্বর উষ্ণপ্রশবন এবং সতীপীঠ।
এখানে দেবী মহিষমর্দিনী ও ভৈরব বক্রনাথ বা বক্রেশ্বর।
পাপহরা নদী পাপমুক্ত করে বলা হয়।এ নদীতেই মহামুনি অষ্টাবক্র স্নান করেছিলেন। এই অঞ্চল বিশেষ করে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জন্য পরিচিত । এ অঞ্চলের আশেপাশে দশটি উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে - পাপহরা গঙ্গা, বৈতরণী গঙ্গা, খরকুণ্ড, ভৈরবকুণ্ড, অগ্নিকুণ্ড, দুধকুণ্ড, সূর্যকুণ্ড, শ্বেতগঙ্গা, ব্রহ্মাকুণ্ড, অমৃতকুণ্ড।এগুলোতে স্নান করলে রোগমুক্তি হয়। প্রতিটি প্রস্রবণের কাছে শিবলিঙ্গ আছে। খর, ভৈরব ও সূর্যকুণ্ডের জলের তাপমাত্রা যথাক্রমে 66, 65 ও 61 ডিগ্রি সেলসিয়াস। অগ্নিকুণ্ডের তাপমাত্রা 80 ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই কুণ্ডের জলে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, সিলিকেট, ক্লোরাইড, বাইকার্বোনেট ও সালফেট পাওয়া যায়, যা ঔষধিগুণসম্পন্ন। এছাড়াও এই কুণ্ডের জলে রেডিওঅ্যাকটিভ উপাদানও পাওয়া যায়। দুধকুণ্ডের তাপমাত্রা ৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকালের দিকে এই কুণ্ডের জলে ওজোন ঘনীভূত হয়ে সাদা সরের মতো পদার্থ সৃষ্টি করে।
বীরভূমের বক্রেশ্বরে এই শক্তিপীঠে ৮টি কুণ্ড দেখা যায়। এই কুণ্ডগুলির মাহাত্ম্য এক একটি এক রকম।
১) “ক্ষারকুণ্ড”- এর একটি ঘটনা আছে। একবার মহর্ষি অগস্ত্য সাগর বারি এক গণ্ডূষে পান করতে আরম্ভ করেছিলেন। সেসময় লবণ সাগর এখানে একটি কুণ্ড আকারে আশ্রয় নেয়। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তে এই কুণ্ডে অবগাহন করলে অক্ষয় কাল স্বর্গে তার স্থান হয়।
২) “অগ্নিকুণ্ড”- হিরন্যকশিপু কে বধ করতে ভগবান বিষ্ণু নৃসিংহ অবতার নিয়েছিলেন। অসুর বধের পর ভগবান নৃসিংহের ক্রোধে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হবার উপক্রম হলে ভক্ত প্রহ্লাদ, ভগবানের চরণে পড়ে স্তবস্তুতি করলে ভগবান হরি তুষ্ট হন। ভগবান বিষ্ণুর সবথেকে উগ্র অবতার হলেন নৃসিংহ অবতার। ভগবান নৃসিংহ তাঁর তেজ থেকে এক কুণ্ড নির্মাণ করেন এখানে, এর নাম অগ্নিকুণ্ড। এখানে কেউ স্নান করেন না। কারন এই কুণ্ডের তাপ অনেক। তবে বৈশাখী পূর্ণিমা তে এখানে পিণ্ড দিলে পিতৃপুরুষেরা মুক্তি লাভ করেন।
৩) “ভৈরবকুণ্ড” – ভগবান শিব সর্ব পবিত্র নদী, পুষ্করিণীর জল একত্র করে এখানে একটি কুণ্ড নির্মাণ করেন। যাঁর নাম ভৈরবকুণ্ড। এখানে চৈত্র মাসের শুক্ল অষ্টমীতে স্নান করলে রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়।
৪) “সৌভাগ্যকুণ্ড”- দেবাদিদেব ভগবান শিব ও তাঁর সহধর্মিণী মাতা ভবানীর সমস্ত অঙ্গের স্বেদ বিন্দু থেকে এই কুণ্ডের উৎপত্তি হয়। এখানে স্নান করলে সর্ব পাপ নষ্ট হয়ে, ভক্তেরা দেহান্তে কৈলাস লোক প্রাপ্তি করেন।
৫) “জীবিতকুণ্ড”—নিশানাথ সোমদেব এখানে স্নান করে সুস্থ হন। অনেক আগে সর্বনাম নামক এক ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নী চারুমতির সাথে এখানে তীর্থ করতে আসেন। ব্রাহ্মণ এখানে বাঘের পেটে গেলে, ব্রাহ্মণী ভগবান শিবের আরাধনা করেন। ভগবান শিব প্রকট হয়ে ব্রাহ্মণীকে আদেশ দেন, ব্রাহ্মণের অস্থি এই কুণ্ডে নিক্ষেপ করতে। ব্রাহ্মণী তা করতেই কোথা থেকে যেনো ব্রাহ্মণ বেঁচে ফিরে এলেন। মাঘ মাসের শুক্ল অষ্টমীতে এই কুণ্ডে স্নান করলে অপমৃত্যু হয় না।
৬) “ব্রহ্মাকুণ্ড”- প্রজাপতি ব্রহ্মা এখানে পাপ স্ফলনের জন্য এখানে কুণ্ড খনন করে ‘ত্যম্বক’ মন্ত্রে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ করেন। এই কুণ্ডে স্নান করলে ব্যভিচারাদি পাপ দূর হয় ।
৭) “শ্বেতগঙ্গা”- এই স্থানে সত্য যুগে শ্বেত নামক এক রাজা থাকতেন। তিনি রোজ এখানে ভৈরব বক্রনাথের পূজা দিতে আসতেন। বক্রনাথ তুষ্ট হয়ে বর দিলেন যে এই তীর্থের সাথে রাজা শ্বেতের নাম জড়িয়ে থাকবে। এই বলে ভৈরব বক্রনাথ এখানে এক কুণ্ড সৃষ্টি করলেন। ঐ কুণ্ডের নাম শ্বেতগঙ্গা। মাঘ মাসে এই কুণ্ডে স্নান করলে গঙ্গা স্নানের পুন্য প্রাপ্তি হয়।
৮) “বৈতরণী”- বৈতরণী পার হলে যম লোক থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই এই কুণ্ডে অবগাহনে নরক ভয় দূর হয়।
এই হোলো এই অষ্ট কুণ্ডের কথা। এই তীর্থ অনেক প্রাচীন।
নলহাটি শক্তিপীঠ:- নলাটেশ্বরী মায়ের মন্দির বহু পুরানো । স্বপ্নাদেশে এখানে পূজো শুরু হয় । ভগবান বিষ্ণুর চক্রে খন্ডিত হয়ে মা সতী দেবীর অঙ্গ এইস্থানে গুপ্ত অবস্থায় ছিলো । “এই স্থানে দেবী সতীর নলী পতিত হয়েছে ।এই স্থানে নলাটেশ্বরী দেবীরূপে অবস্থান ।
গর্ভগৃহে পাহাড়ের প্রস্তরে খোদাই করা মায়ের মুখ । মুখটি মা কালীর । সিঁদুর দিয়ে লিপ্তা মায়ের বিগ্রহ । বস্ত্র, কুঙ্কুম শোভিতা তিনি । অপূর্ব স্নিগ্ধ ভরা মায়ের মুখ । সেই রূপ দেখলে পথশ্রমের ক্লান্তি দূর হবে । সতীপীঠের অঙ্গশিলা গুপ্ত থাকে। সাধারনের এটি দর্শন করা বারণ ।
পীঠনির্ণয় তন্ত্রের মতে চতুশ্চত্বারিশৎ পীঠ হল বীরভূমের নলহাটি । ভৈরব অবশ্য সর্বত্র যোগীশ নামেই উক্ত ।
" নলহাট্যাং নলাপাতো যোগী শো ভৈরবস্তুথা।
তত্র সা কালিকা দেবী সর্বসিদ্ধি প্রদায়িকা ।।"
" মঙ্গলাং শোভনাং শুদ্ধাং নিস্কলং পরমম্ কলাং।
নলাটেশ্বরী বিশ্বমাতা চণ্ডিকাং প্রণমাম্যহম্ ।।"
গর্ভগৃহে পাহাড়ের প্রস্তরে খোদাই করা মায়ের মুখ । মুখটি মা কালীর । সিঁদুর দিয়ে লিপ্তা মায়ের বিগ্রহ । বস্ত্র, কুঙ্কুম শোভিতা তিনি । অপূর্ব স্নিগ্ধ ভরা মায়ের মুখ । সতীপীঠের অঙ্গশিলা গুপ্ত থাকে। সাধারনের এটি দর্শন করা বারণ ।
নলাটেশ্বরী মায়ের অঙ্গশিলা উদ্ধারের সময় একটি অলৌকিক কান্ড হয় । যেটা বোধহয় অপর কোন শক্তিপীঠে হয়নি । যিনি সতীর দেহ তার সুদর্শন চক্র দ্বারা খণ্ড খণ্ড করেছিলেন সেই অনাদির আদি গোবিন্দের চরণ চিহ্নিত একটি শিলা পাওয়া যায় । ভগবান নারায়ণের সেই চরণ চিহ্নিত শিলা পূজিত হন এখানে দেবীর সাথে । প্রথমে ভগবান বিষ্ণুকে প্রনাম জানানোর পরই ভৈরব ও দেবীর অর্চনা হয়ে থাকে ।
নন্দীকেশ্বরী সতীপীঠ
নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ:- এই সতীপীঠটি বীরভূমের সাঁইথিয়াতে অবস্থিত । বিষ্ণুর চক্রে খন্ডিত হয়ে মাতা সতীর কণ্ঠের হার মতান্তরে কণ্ঠের অস্থি( দেবীর মৃতদেহের ঘাড়-হাড় ) এখানে পতিত হয় । বর্তমান মন্দিরটি 1913 সালে নির্মিত হয়েছিল ।
দেবীর হস্তে অবস্থিত সকল আভূষণ এমনকি হস্তের পদ্মটিও এক একটি দেবী শক্তি । সুতরাং দেবীর কন্ঠমাল্য থেকে দেবী সৃষ্টি হতেই পারে । পীঠনির্ণয়তন্ত্র শাস্ত্রে লিখিত আছে -
হার পাতো নন্দিপুরে ভৈরবনন্দিকেশ্বরঃ নন্দিনী সা মহীদেবী তত্র সিদ্ধি ভবাপ্লুয়াত্ ।।
দেবীর নাম এখানে নন্দিনী । ভৈরব হলেন নন্দিকেশ্বর । অনেকে এই দেবীকে নন্দিকেশ্বরী বলে ডাকেন । দেবীর নামটি 'নন্দী' থেকে উৎপন্ন , যে শিবের বাহন, অনুসরণকারী এবং ঈশ্বরী মানে দেবী। যার অর্থ নন্দী দ্বারা যিনি পূজিত। কালীপুজোর সময় এখানে আলাদা করে পুজো হয় না। সারা বছরই পূজিতা হন দেবী।
তন্ত্রচূড়ামণি মতে এখানে দেবীর কণ্ঠের মাল্যহার (কণ্ঠের অস্থি- দেবীর মৃতদেহের ঘাড়-হাড় )পতিত হয়েছিলো । বীরভূমের সাঁইথিয়া রেল স্টেশনের পাশেই ইঁটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা দেবীর মন্দির । একটি প্রাচীন বট গাছ এখানে আছে । মন্দিরে দেবী সতীর অঙ্গশিলা দেখা যায় । সেখানেই পূজা হয় । মন্দিরের প্রধান মূর্তিটি কালো পাথরের, যা এখন প্রায় লাল। কারণ ভক্তরা প্রার্থনার জন্য পাথরের গায়ে সিন্দুর দেন। দেবীর একটি রূপালী মুকুট এবং তিনটি সোনালী চোখ । সেই লাল সিঁদুরে লিপ্তা অঙ্গশিলায় রূপোর নয়ন, নাসিকা, কর্ণ, মুখ বসানো। পাশেই ভৈরবের মন্দির ।
রাম-সীতা মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, শিব মন্দির, মহা সরস্বতী মন্দির, মহা লক্ষ্মী-গণেশ মন্দির, লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির, ভৈরব নন্দীকেশ্বরী মন্দির, হনুমান মন্দির সহ উল্লেখযোগ্য কিছু মন্দির রয়েছে। একটি বিশাল পবিত্র গাছ রয়েছে যেখানে ভক্তেরা তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য লাল এবং হলুদ সুতা বাঁধেন।
ভগবতী মা নন্দিনী কে প্রনাম জানিয়ে বলি -
কমলদলামল কোমলকান্তি কলাকলিতামল ভাললতে সকলবিলাস কলানিলয়ক্রম কেলিচলৎকল হংসকুলে ।অলিকুলসঙ্কুল কুবলয়মণ্ডল মৌলিমিলদ্বকুলালিকুলে জয় জয় হে মহিষাসুরমর্দিনী রম্যকপর্দিনি শৈলসুতে ।।
এর অর্থ- হে মাতঃ । তোমার সুন্দর প্রশস্ত ললাট খানি পদ্ম পত্রের মতো অমলিন নিষ্কলঙ্ক, তুমি ক্রমবর্ধমান চন্দ্রকলার মতো উজ্জ্বল ও মনোহরণ কান্তিময়ী, সর্ব বিধ নৃত্যকলা ভঙ্গিমা বিলাসিত হংসগতিই তোমার চলনভঙ্গি । তোমার মস্তকের চূড়ার মতো বদ্ধ কেশে অলিকুল সমাবৃত বকুল ফুল, সেই মৌমাছির দল যেমন করে পদ্মফুলে দলে ভীড় করে ঠিক তেমন ভাবেই তারা সেই বকুল ফুলের দিকে ধাবমান । তুমি শৈলসুতা জটাজুটধারিণী পার্বতী । তুমিই মহিষাসুর বধ করেছো । তোমায় জয় হোক ।
লাল রঙের মন্দিরের পিরামিডাল গম্বুজটি দেবী নন্দিনীর গর্ভগৃহকে নির্দেশ করে যেখানে তিনি নন্দিকেশ্বর নামে পরিচিত তার ভৈরবের সাথেও পূজিত হন।
সেখানে কোনো মূর্তি নেই, দেবতাকে কচ্ছপের আকৃতির পাথর হিসেবে পূজা করা হয়, যা সিঁদুরে ডুবানো হয়। দেবতা একটি রৌপ্য মুকুট এবং তিনটি সোনালী চোখ দিয়ে শোভিত। ভক্তরা তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য মন্দিরের পাশে অবস্থিত প্রাচীন বটগাছের উপর একটি লাল বা হলুদ ধাগা (সুতো) বেঁধে রাখে।
সাধক বামাখ্যাপা যখন মায়ের দেখা পাওয়ার জন্য তারাপীঠে সাধনা করছেন, আকুল হয়ে মা কে ডাকছেন, ঠিক সেই সময় তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন মা নন্দীকেশ্বরী। বামখ্যাপাকে মা নন্দীকেশ্বরী স্বপ্নাদেশ দেন আগে তাঁর পুজো করতে, তারপরেই সিদ্ধিলাভ হবে। স্বপ্নাদেশ পেয়ে বামাখ্যাপা মা নন্দীকেশ্বরীর দ্বারে পুজো দেন এবং এবং সিদ্ধিলাভ করেন। তারপর থেকে আজও তারাপীঠের দর্শনার্থীদের অনেকেই যাতায়াতের পথে মা নন্দীকেশ্বরীর মন্দিরে প্রণাম করে যান।
জয় জয় নন্দিকেশ্বরী
নন্দীকেশ্বরী মন্দিরটি নন্দীপুর গ্রামে অবস্থিত, যা এখন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া শহরের একটি অংশ । সাঁইথিয়া শহরটি ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে অবস্থিত। নন্দীকেশ্বরী মন্দিরের নামানুসারে সাঁইথিয়া ‘নন্দীপুর’ নামেও পরিচিত। সাঁইথিয়া হল বীরভূম জেলার সিউড়ি সদর মহকুমার একটি শহর ও পৌরসভা।
নন্দীকেশ্বরী মন্দির এর অন্যান্য মন্দির শিব মন্দির, মহা সরস্বতী মন্দির, মহা লক্ষ্মী গণেশ মন্দির বিষ্ণু লক্ষ্মীর মন্দির রাধা গোবিন্দ মন্দির, ভৈরব নন্দীকেশ্বরী মন্দির, হনুমান বজরংবলী মন্দির এছাড়াও একটি প্রাচীন বটগাছ রয়েছে যা মন্দিরের অভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়েছে এবং ভক্তরা এই পবিত্র স্থানে মা দুর্গার উদ্দেশ্যে লাল রঙের দড়ি দিয়ে বাঁধেন।
Address: 165, Mayurakshi Sarani, Beside Sainthia Rail station, Sainthia, West Bengal,PinCode:-731234
Nandikeshwari Temple Opening & Closing Timing:
Daily Temple Open From 06:00 A.M -to -01:00 P.M and 05:00 P.M -to 01:00 P.M
Daily Temple Close From 01:00 P.M-to- 05:00P.M
সকাল 6.00 টা থেকে 10.00 টা পর্যন্ত মন্দিরের দরজা ভক্তদের জন্য খোলা থাকে।
মন্দিরের আচার-
বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা (পূর্ণিমা) এবং কালী পূজার শুভ উপলক্ষে সাঁইথিয়ার এই মন্দিরে বিশেষ পূজা ও যজ্ঞ করা হয়।
নিত্য পূজা, পূজা ও আরতি ছাড়াও প্রতিদিন দুপুরে মাতা নন্দীকেশ্বরীকে অন্ন-ভোগ দেওয়া হয়। পরে দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।
কালীঘাট শক্তিপীঠ / কালীঘাট মন্দির:- কলকাতার একটি প্রসিদ্ধ কালীমন্দির এবং একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র। এই তীর্থের পীঠদেবী দক্ষিণাকালী এবং ভৈরব বা পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর রূপে পূজিত হন। পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে, সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর ডান পায়ের চারটি আঙুল এই তীর্থে পতিত হয়েছিল। পুরাণ মতে এ স্থান বারাণসী তুল্য ।
বলা হয় বেহালা থেকে 2 যোজন ব্যপি কালি ক্ষেত্রের 3 প্রান্তে অবস্থিত স্বয়ং ব্রহ্মা , বিষ্ণু ও শিব আর তার মাঝেই দেবীর অবস্থান। দেবী এখানে ভৈরবী , বগলা , মাতঙ্গী , বিদ্যা , কমলা , ব্রাহ্মী , মহেশ্বরী , চণ্ডী প্রভৃতি রূপে পূজিতা । দীপান্বিতা অমাবস্যাতে দেবীকে মহালক্ষ্মী রূপে পূজা করা হয়। 1 টি সিন্দুকে সতীর প্রস্তরীভূত অঙ্গটি রক্ষিত আছে; এটি কারোর সম্মুখে বের করা হয় না আর এটি ব্রহ্মবেদীর নিচে রয়েছে।
আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামক এক মাতৃসাধক একদা এখানে কালীর ধ্যান করছিলেন। এরপর একরাতে তিনি দেবীর কন্ঠ শুনতে পান। তাকে বলা হয়, সে যে বেদীতে বসে ধ্যান করছিলেন সেটি ব্রহ্মবেদী( অর্থাৎ একদা ব্রহ্মা সেখানে বসে দেবীর ধ্যান করতেন), আর দেবীর সেই অঙ্গ পাশের কালীন্দি হ্রদে রয়েছে। তাকে এও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, নিলগিরী পর্বতে ব্রহ্মানন্দ গিরী নামক একজন সাধক আছেন, তার কাছে যে কষ্টিপাথরের শিলাস্তম্ভ রয়েছে, তা যেন সেই ব্রহ্মবেদীতে স্থাপন করা হয়। এরপর আত্মারাম নীলগিরী গিয়ে ব্রহ্মানন্দের সাথে দেখা করেন। ধারণা করা হয় কোন দৈববলে সেই 12 হাত লম্বা আর 2 হাত চওড়া সেই শিলাকে কালীঘাটে আনা হয়েছিল। বলা হয় তখন স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা সেখানে আবির্ভূত হয়ে সেই শিলাকে মাতৃরূপ দেন আর তা ব্রহ্মবেদীতে স্থাপন করেন। এভাবে দেবীর স্থাপনা হলেও তখনও দেবীর সেই খণ্ডিত চরণ নিখোঁজ, এমতাবস্থায় একরাতে কালীন্দি হ্রদের পাশে সাধনাকালে আত্মারাম ও ব্রহ্মানন্দ হ্রদের ভেতরের একটি স্থান থেকে আলো দেখতে পান। পরদিন ভোরে তারা সেখানে মায়ের চরণাংশ পান। এটি ছিল স্নানযাত্রার দিন, অর্থাৎ জৈষ্ঠ পূর্ণিমার দিন। এদিন আজও প্রথা মেনে বিশেষ পূজা হয়। কালীমন্দিরের পশ্চিম দিকে রয়েছে শ্যাম রায়ের মন্দির।
কালীঘাট কালীমন্দিরের কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিটি অভিনব রীতিতে নির্মিত। মায়ের মাথা সোনার মুকুটে শোভিত ।
যুগাদ্যায়ং মহাদেব দক্ষাঙ্গুষ্ঠং পদোমম
নকুলীশঃ কালীপীঠে দক্ষপদাঙ্গুলি সু চ মে
সর্বসিদ্ধিকারী দেবী কালিকা তত্র দেবতা।।
বঙ্গানুবাদ: "কালীঘাট মহাশক্তিপীঠ। সকল পীঠস্থানের শ্রেষ্ঠ। কালীপীঠের দেবী মহাশক্তিস্বরূপিণী কালী। আর পীঠরক্ষক হলেন ভৈরব নকুলেশ্বর। এখানে পুজো দিলে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কালীঘাটের দেবী কালিকা সর্বসিদ্ধিকারী।"