গুরুদেবের কর্মযজ্ঞে সহায়তাই গুরুভক্তি গুরু মুখ নিঃশৃত বানীই সত্য, নিশ্চল, ঈশ্বরীয়, পরমের ভাবে বিরাটের ভাবে ভাবময় হয়ে শব্দ রূপে প্রকাশিত। গুরু মুখ নিঃশৃত কথাগুলিকে মনন, স্মরণ, নিধিধ্যাসনের মাধ্যমে বারবার চর্চা করতে হয়। তবেই তার মধ্যে থেকে জ্ঞানের পুর্ন বিকাশ ঘটা সম্ভব। ঈশ্বরীয় আলোচনা গুরুর মুখে শ্রবণ করার সময় শিষ্যদের খেয়াল রাখতে হয়, যে ঈশ্বরীয় কথা ঈশ্বরীয় আবেশেই গুরুর মুখ থেকে নিঃশৃত হচ্ছে, সেই সময় মন-কে পুর্ন একগ্রতার সাথে গুরুর উপর নিবেশ করতে হয়। “সংসারের মায়াকে কাটিয়ে গুরুর কাছে বসে তাঁর মুখ নিঃশৃত বানীকে শ্রবণ করা ও মনন করার নামই ‘উপনিষদ”।” “ঈশ্বরের স্বরূপ-কে বুঝতে হলে আগে গুরুসত্ত্বা ও গুরুর স্বরূপ-কে বুঝতে হবে, তাকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। তবেই বোঝাটা বোঝদারের মতো হবে। বুঝদার হতে হলে আগে গুরুকে বুঝতে হবে, না হলে সব ব্যার্থ।” জগতের “বোঝার” বোধ নিয়ে কখনও গুরুর সংগ কোরো না, তা হলে ‘বোঝার’ বোধে ফাঁক থেকে যাবে।” “মানসিক বিকার থেকে মুক্ত হয়ে গুরু সংগ করতে হয়। হিংসা, ঈর্ষা, নিন্দা এসবের থেকে মুক্ত হয়ে ‘মুক্ত-মন’ নিয়ে গুরু সংগ করতে হয়।” “গুরু সংগে মনে ঈশ্বরীয় ভাবের উদয় হয়। যতক্ষণ তুমি গুরুসংগে আছো ততক্ষন পর্যন্ত তুমি সংসারের মায়া থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরীয় ভাবের জগতের পথিক।” “গুরু শক্তি স্বঃতই প্রকাশিত। তাঁকে গ্রহণ করার মতো জ্ঞান শ্রদ্ধা ভক্তি বিশ্বাসের একান্ত প্রয়োজন।” “যে মানব জীবন সৌভাগ্যক্রমে “গুরু”-র সন্ধান পেয়েছে এবং গুরুকৃপা পেয়েছে সেই মানব জীবন ধন্য।” “অনন্ত জিবনের অবসান শেষে গুরু কৃপা লাভ হয়। হতভাগয় মানুষ সেই অনন্ত কৃপাকেও কখনও কখনও দুর্ভাগ্যের বসে হারিয়ে ফ্যালে।” গুরুর সংগ করার সময় প্রতিটি শিষ্যের উচিত এমন কোন ভাব প্রকাশ না করা যাতে গুরুর সংগ করার সময় যে শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটে তা ব্যাহত হয়। তবে সেটা হবে পরম দুর্ভাগ্যের ঘটনা।” গুরুর ভাষণ, সমস্ত মনকে একাগ্র করে শুনতে হয়। এক কথার বহু অর্থ হয়ে থাকে, তাকে হৃদয়ঙ্গম করে নিতে হয়। নইলে গুরু সংগ বৃথা।” প্রতিটি মুহুর্ত্তে গুরুর সন্তুষ্টির দিকে নজর রাখতে হয়। গুরুর সন্তুষ্টির উপরই প্রতিটি শিষ্যের অধ্যাত্তিক উন্নতী ও সাধন সিদ্ধির পথ খোলা রয়েছে। সুতরাং সাবধান।” “গুরুর স্বরূপ-কে বুঝতে জন্মান্তও লেগে যায়। তাই সব সময় সচেষ্ট থাকতে হয় জন্ম মধ্যেই যেন তাঁকে উপলব্ধি করতে পারো।” “গুরুর কাছে আসার আগে আমার আমিত্ত্বটাকে বিসর্জন দিয়ে আসতে হয়। নইলে গুরুর স্বরুপকে আত্মগত করা যায় না।” “অহংকারী মন নিয়ে কখনও গুরুকে বুঝতে চেষ্টা কোরো না। তাতে হীতে বিপরীত ফল লাভ হয়। গুরু হলেন আয়ণার মতো, তুমি যে মন বা ভাব-কে নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াবে সেটাই গুরুর মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হবে।” “সহজ সরল শিশুর মতো হয়ে গুরুর কাছে যাও। দেখবে তোমার সমস্ত আকাংখাই তিনি পূরণ করেছেন। মা যেমন শিশুর সমস্ত কামনা পূরণ করেন, গুরুও তেমনি শিশু মনের শিষ্যের বায়ণা পূরণ করেন।” “সংসারের চিন্তা নিয়ে কখনও গুরু সংগ করবে না, তাতে লাভের বদলে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী। সংসারের ‘সার’ হলেন গুরু। সুতরাং ‘সংগ’ সেজে ‘অসার’ বস্তুর সন্ধানে গুরুর কাছে না গিয়ে, গুরুর ‘সমসারের’ সঙ্গী হও। তবেই দেখবে সংসার “সমবোধের সার” হয়ে উঠেছে।” “শিষ্যের উচিত গুরুর জন্য নিবেদিত প্রাণ হওয়া, গুরুর কথার ব্যাখ্যা না বুঝে তাঁর সমালোচনা করার মতো পাপ এই জগতে আর কিছু নেই। অনন্ত জীবন এই সামান্য ভূলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। গুরু সমস্ত সমালোচনার উর্দ্ধে। তাঁর কথার সমালোচনা করা তো দুর, তাঁর কথার মানে বুঝতে হলেও শিষ্যকে বার বার জন্মাতে হতে পারে।” গুরুর কোন কথার মানে না বুঝতে পারলে তাঁকে বার বার জিজ্ঞেস করতে হয়। নতুবা নিজের মতো করে মন গড়া কোন ব্যাখ্যা করে নেওয়া ভয়ানক অপরাধ।” “গুরু বাক্য ব্রহ্মবাক্য। তা চিরকালের সত্য। কোন অবস্থাতেই তা মিথ্যে হয় না।” গুরুর সান্নিধ্যে থেকে গুরুর মতো হয়ে ওঠাই প্রতিটি শিষ্যের কর্ত্তব্য।” জগতের ভার বহন করার জন্যই গুরুর আত্মপ্রকাশ ঘটে। জগৎ সংসারের সমস্ত কিছুর মূলেই গুরুশক্তি কাজ করে চলেছে। গুরুর ভার বহন করার সাধ্য কারোর নেই।” “গুরুশক্তি অমোঘ। তাকে নাশ করার ক্ষমতা কারোর নেই। অবিনাশী শক্তিই হলো গুরু শক্তির অপর নাম।” “গুরুর জাগতিক কর্মকাণ্ড-কে কখনও সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে যেওনা। তাহলে অবশ্যই ঠকতে হবে।” কোন কোন শিষ্যের মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি বর্ত্তমান থাকা সত্তেও শুধু গুরুবাক্য অবহেলা করার জন্য তাঁদের ভয়ানক আধ্যাত্মিক পতন ঘটে যায়। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় অসম্ভব। এই অসম্ভব কর্ম থেকে রক্ষা পাওয়ার যদি কোন মাত্র উপায় থাকে তা কেবল “গুরুপদ শরণম”।” কোন কোন শিষ্যের মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি বর্ত্তমান থাকা সত্তেও শুধু গুরুবাক্য অবহেলা করার জন্য তাঁদের ভয়ানক আধ্যাত্মিক পতন ঘটে যায়। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় অসম্ভব। এই অসম্ভব কর্ম থেকে রক্ষা পাওয়ার যদি কোন মাত্র উপায় থাকে তা কেবল “গুরুপদ শরণম”।” গুরু প্রতিটি শিষ্যের মধ্যে তাঁরই রূপে বসে আছেন লীলা করবার জন্য। শিষ্যদের এটি বোঝার ক্ষমতা নেই। এই না বোঝার ফলেই ভূল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, গুরু শিষ্য আলাদা দুটি সত্তায় পরিণত হয়।” “সহজ সরল মনে হয় গুরুর বাস, মনের সরলতাই গুরুর আনন্দের বস্তু, আর সহজতাই গুরুর কাছে আদরের ধন।” “গুরুর মুখ নিঃশৃত বানীকে শুধু শুনে গেলেই চলবে না। তাকে মনন ও চিন্তনের মাধ্যমে নিজের জীবনে প্রয়গ করতে হবে। তবেই গুরুসঙ্গ সফল।” “সংসারের চিন্তাকে সৎসঙ্গের সময় মনে স্থান দিয়ো না। তবে গুরু সান্নিধ্য লাভ করাটাই বৃথা হয়ে যাবে।” যতক্ষণ তুমি গুরু সান্নিধ্যে সময় কাঁটাবে, ততক্ষণই তোমার বিগত জন্মের প্রারব্ধের ফল নষ্ট হতে থাকবে। তোমার অজান্তেই তুমি ধীরে ধীরে দেবত্তের পথে উন্নীত হবে।” “গুরুর কাছে শুধু শুধু সময় কাঁটাবার জন্য এসো না। যখনই গুরু সান্নিধ্যে যাবে কিছু না কিছু জ্ঞান নিজের ঝুলিতে ভরে নিয়ে আসবে।” “গুরুর প্রতিটি আদেশকে যে জীবনে মান্য করতে পেরেছে, সেই প্রকৃত শিষ্য, তাঁর সব ভার গুরুই বহন করেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।”
শাস্ত্রীয় আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা অর্থাৎ নিত্য-অনিত্য বিচার সহকারে বৈদিক অনুশাসন আমাদেরকে আমাদের জন্ম- জন্মান্তর এর ভ্রম ও অজ্ঞতা দূর করতে এবং ভিতরের দেবত্ব আবিষ্কার করতে সক্ষম করে ঐশ্বরিক চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করতে এবং সর্বোচ্চ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথেষ্ট।
বৈদিক অনুশাসন এবং ক্রিয়াযোগ অধ্যবসায়ের মাধ্যমে একজন অবশেষে সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার কর্তার সাথে সংযুক্ত হবে। এই অবস্থায় যখন একজন জিনিসের সারমর্ম অর্জন করে, "মহাবিশ্ব জয়ী হয়"। সন্তুষ্টি, শক্তি, প্রজ্ঞা এবং সমস্ত কিছুকে সমর্থন করার ক্ষমতা বিশ্বজয়ী ব্যক্তির স্পষ্ট গুণ। এই গুণাবলী এবং আরও অনেক কিছু একজন মানুষের প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, যিনি পৃথিবীতে বাস করেই মনের সমতা লাভ করেছেন। বাস্তবতার চিরন্তন একত্বে মনের সমানতার স্থিতিশীল অবস্থা বিশুদ্ধ চেতনা বা সর্বব্যাপী সত্তার ক্ষেত্রের অন্তর্গত। এটি জীবন-শক্তির উৎস, শাশ্বত জ্ঞানের আধার, প্রকৃতির সমস্ত শক্তির উত্স এবং বিশ্বের সমস্ত সাফল্যের উত্স। যখন আপনি আপনার হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠে বসবাসকারী এক পরম আত্মার সাথে আপনার একত্ব উপলব্ধি করেন। যখন আপনি সত্যিকার অর্থে সেইটিতে প্রতিষ্ঠিত হন, যা শান্তি ও আনন্দের সাগর, তখন আপনি আর দুঃখ, ক্ষতি বা ব্যর্থতার প্রবল আঘাত বা অন্যের অসংলগ্ন এবং অসম্মত কম্পনের দ্বারাও আর কেঁপে উঠবেন না। স্বার্থের বা চাহিদার ভালোবাসা কোনো প্রকৃত ভালোবাসা নয়! সত্যিকারের ভালবাসার প্রথম লক্ষণ হল যখন ভালবাসা কিছুই চায় না এবং যখন এটি সবকিছু দেয়।
ভালোবাসা শুরু হয় দ্বৈত থেকে এবং শেষ হয় ঐক্যে।
“অন্তহীনের বাঁশি এর ধ্বনি হল প্রেম। প্রেম যখন সমস্ত সীমানা ত্যাগ করে তখন তা সত্যে পৌঁছে যায়।" অনাহত ধ্বনি বা "কৃষ্ণের বাঁশি" দ্বারা আকৃষ্ট যোগীর মন অবশ্যই সমাধির অতি-চেতন অবস্থা লাভ করবে।যেমন মধুর স্বাদ গ্রহণকারী মৌমাছিটি কেবল ফুলের গন্ধে আকৃষ্ট হয় না, এই জাতীয় যোগীর মন আর পুরানো বাসনের বা আচরণগত প্রবণতাগুলিতে আগ্রহী হবে না। ওম-প্রণবের শব্দ কম্পনে তার মন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায় এবং বাহ্যিক ইন্দ্রিয়-জগতকে ভুলে যায়। শুধু শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়ো শিকড় থেকে। তাই ভগবান কৃষ্ণের বাঁশি হল প্রণবের প্রতীক। ধ্যানের সময় যখন আমাদের মন খুব স্থির হয়ে যায় তখন আমরা এই সুন্দর ধ্বনি কম্পনের মাধ্যমে আমাদের সচেতনতা শুনতে পারি এবং সুরক্ষিত করতে পারি। এটি এই বাঁশির মতো। প্রণবের ধ্বনি কম্পন যা গোপীদেরকে যমুনার তীরে তাদের প্রিয় ভগবান কৃষ্ণের সাথে দেখা করার জন্য আকৃষ্ট করেছিল। ঐশ্বরিক অভ্যন্তরীণ ধ্বনির ঐশ্বরিক সুর মোহনীয় এবং বিস্ময়কর শক্তি রয়েছে। যখন এই সুন্দর ঐশ্বরিক সুর প্রবেশ করে হৃদয়ের মূল এটি ভক্তের হৃদয়কে বিশুদ্ধ প্রেমের আনন্দে নাচতে পারে। এই বিশুদ্ধ শব্দ কম্পন হৃদয়কে প্রফুল্ল আনন্দে রোমাঞ্চিত করে এবং দীর্ঘস্থায়ী আনন্দের উদ্রেক করে। ঐশ্বরিক আভ্যন্তরীণ ধ্বনির মাধুর্য ঈশ্বর-নেশা উৎপন্ন করে। প্রণবের মাধুর্য গোপীদের আত্মাকে আলোড়িত করেছিল, তারা ঐশ্বরিক সঙ্গীতে নিজেদের হারিয়েছিল। পৃথিবী তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই অভ্যন্তরীণ ধ্বনিতে লীন হয়ে গেলে এটি উড়ন্ত পাখি, বিচরণকারী গরু, বিচরণ প্রিয় ভক্তের উচ্চ চৌম্বকীয় কম্পন গতিতে নিয়ে আসবে। এই ঐশ্বরিক ধ্বনিতে লীন হয়ে গেলে প্রকৃতি নিজেই নীরব হয়ে যায় যেন এই ঐশ্বরিক সঙ্গীত শুনছে। যখন ভক্ত এই ঐশ্বরিক সুরে লীন হয়ে যায় তখন তাৎক্ষণিক বায়ুমণ্ডল ঐশ্বরিক কম্পন এবং মহাজাগতিক শক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। যখন কেউ ভগবানকে ভিতরের শান্তি হিসাবে জানবেন, তখন আপনি তাকে উপলব্ধি করবেন যে সমস্ত কিছুর বাইরে সর্বজনীন সামঞ্জস্যের মধ্যে বিদ্যমান শান্তি। রহস্যময় এই শান্তি ভিতরে! বিস্ময়কর এই সুখ! এই সুখ শান্তি উপলব্ধি! এই সুখের সাগরে ভাসুন এবং আপনার নিজের শান্তিময় স্থিরতায় আনন্দ করুন!”