আচমন বিধিঃ
আচমন প্রক্রিয়াঃ
কোন শুভ কাজের শুরু তে আচমন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “দেহ-মন শুদ্ধ না থাকলে আধ্যাত্মিক সাধনের যোগ্যতা হয় না। অন্যভাবে, দেহ-মন শুদ্ধ করে নিয়ে তবে সাধন-ভজনে প্রবৃত্ত হতে হয়। আচমনের মুখ্য উদ্দেশ্য দেহ-মন শুদ্ধ করা। বিষ্ণুস্মরণ দেহ-মনশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায়।… আবার আচমন পূজককে পূজার লক্ষ্য সর্বব্যাপক অখণ্ড-চৈতন্য পরমাত্মার দিকে অগ্রসর হওয়ার কথাও পরোক্ষভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়।” (পূজাবিজ্ঞান, পৃ. ১৯) ©মন্ত্র শিক্ষা-"পুরোহিত দর্পণ"
এই কারণে সনাতনী হিন্দুরা যে কোনো পবিত্র কাজ, তা সে পূজাই হোক বা অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানই হোক, তা শুরু করার আগে আচমন করে থাকেন।©মন্ত্র শিক্ষা-"পুরোহিত দর্পণ"
প্রক্ষাল্য পাণী পাদৌ চ ত্রিঃ পিবেদম্বু বীক্ষিতম্।। সম্বৃত্যাঙ্গুষ্ঠমূলেন দ্বিঃ প্রমৃজ্যাত্ততো মূখম্।। সংহত্য তিসৃভিঃ পূর্ব্বমাস্যমেবমুপস্পৃশেৎ। অঙ্গুষ্ঠেন প্রদেশিন্যা ঘ্রাণং পশ্চাদনন্তরম্।। অঙ্গুষ্ঠানামিকাভ্যাঞ্চ চক্ষুঃশ্রোত্রে পুনঃ পুনঃ। বাভিং কনিষ্ঠাঙ্গুষ্ঠেন হৃদয়ন্তু তলেন বৈ।। সর্ব্বাভিস্তু শিভঃ পশ্চাদ্বাহূ চাগ্রেণ সংস্পৃশেৎ। এবং কৃত্বা পয়ঃ পীত্বা বিষ্ণুং স্মৃত্বা শুচির্ভবেৎ।। ইতি স্মৃতিঃ।।
দুই পা এবং দুই হাত ধুইয়া, হস্তে মাষপরিমাণ জল লইয়া তাহা দর্শন করতঃ তিনবার পান করিবে, পরে দুই হাত ধুইয়া ফেলিয়া মস্তকে ও পদে জলের ছিটা দিবে, দক্ষিণ হস্তের বাঁকান অঙ্গুষ্ঠমূল দ্বারা দুইবার মুখ মার্জ্জন করিবে। ৷©মন্ত্র শিক্ষা-"পুরোহিত দর্পণ" অনন্তর অঙ্গুষ্ঠ ও তর্জ্জনী ও মধ্যমা এই তিন অঙ্গুলি মিলিত করিয়া মুখ স্পর্শ করিবে, অঙ্গুষ্ঠ ও তর্জ্জনীর দ্বারা নাসিকা স্পর্শ করিয়া, তৎপরে অঙ্গুষ্ঠ এবং অনামিকা অঙ্গুলি দ্বারা চক্ষুর্দ্বয় ও তৎপরে কর্ণদ্বয় পুনঃ পুনঃ স্পর্শ করিবে। তৎপরে অঙ্গুষ্ঠ ও কনিষ্ঠাঙ্গুলি মিলনে নাভিদেশ এবং হস্ততল দ্বারা বাহুদ্বয় স্পর্শ করত; বিষ্ণুস্মরণপূর্ব্বক শুচি হইবে।
গোকর্ণাকৃতিহস্তেন মাষমগ্নং জলং পিবেৎ।
তন্ন্যুনমধিকং বাপি পিবেচ্চেদ্রুধিরন্তু তৎ।।
হাতের তেলো গরুর কাণের ন্যায় করিয়া, একটি মাষকলাই ডুবিতে পারে, এতটুকু পরিমাণ জল লইয়া আচমনের সময় তাহাই পান করিবে, তিনবার তিন অঞ্জলি ততটুকু জল লইতে হয়। তাহার অধিক বা অল্প জল পান করিলে, শোণিতপানের ফল হয়।©মন্ত্র শিক্ষা-"পুরোহিত দর্পণ"
অঙ্গুল্যগ্রে তীর্থং দ্বৈহং স্বল্পাঙ্গুল্যোর্মূলে কায়ম্।
মধ্যেহঙ্গুষ্ঠাঙ্গুল্যোঃ পৈত্রং মূলে অঙ্গুষ্ঠস্য ব্রাহ্মম্।। ইত্যমরঃ।।
সমস্ত অঙ্গুলির অগ্রভাগকে দৈবতীর্থ বলে। কনিষ্ঠা ও অনামিকার মূলদেশকে কায়তীর্থ বলে। অঙ্গুষ্ঠ ও তর্জ্জনীর মধ্যদেশকে পৈত্রতির্থ এবং বৃদ্ধাঙ্গুলির মূলদেশকে ব্রাহ্মতীর্থ বলে। আচমন সময়ে এই ব্রাহ্মতীর্থে জল লইয়া আচমন করিতে হয়।©মন্ত্র শিক্ষা-"পুরোহিত দর্পণ"। বৃদ্ধাঙ্গুলিকে অঙ্গুষ্ঠ, তৎপরে অঙ্গুলিকে ক্রমে তর্জ্জনী, মধ্যমা, অনামিকা ও কনিষ্ঠা বলে।
আচমনের দুটি অংশ। প্রথমটি মূল আচমন প্রক্রিয়া, দ্বিতীয়টি তার আনুষঙ্গিক বিষ্ণুস্মরণ। আচমন প্রক্রিয়াটি ওঁ-কারযুক্ত শুদ্ধ বিষ্ণুনাম উচ্চারণ-সহ কয়েকটি প্রতীকী ক্রিয়া। বিষ্ণুস্মরণের সময় আমরা সাধারণত যে মন্ত্রটি উচ্চারণ করি, সেটি হল—
ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম্। ১ [ অর্থ -------- ধার্মিক জ্ঞানীরা দ্যুলোকের বিশাল চক্ষু সূর্যাদি ন্যায় সর্বব্যাপক পরমাত্মার সেই পরম পদ সন্দর্শন করেন। ---ভাবার্থ -------- প্রাণী যেমন সূর্যের সাহায্যে শুদ্ধনেত্র দ্বারা মূর্ত্তিমান পদার্থকে দর্শন করে ধার্মিক বিদ্বানেরা শুদ্ধ জ্ঞাননেত্র দ্বারা তেমনই নিজের মধ্যে পরমাত্মার পরমপদ মোক্ষকে সন্দর্শন করেন। ]
ওঁ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোঽপি বা।
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।। ২
মন্ত্রটির বাংলা অর্থ—
আকাশের সূর্যের মতো সর্বত্র প্রকাশমান, বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ, পরম তত্ত্ব জ্ঞানীগণ সর্বদা দর্শন করেন। ১
বাহ্য শরীর ও শরীরের অভ্যন্তরে স্থিত মনের কোনো একটি বা দুটিই যদি অপবিত্র হয়, তবে পদ্মলোচন শ্রীবিষ্ণুকে স্মরণ করা মাত্রই বাহ্য ও অন্তরে শুদ্ধ হওয়া যায়। ২ ©মন্ত্র শিক্ষা-"পুরোহিত দর্পণ"
“কর্মের (পূজা) সূচনায় সাধকও প্রার্থনা করছেন—জ্ঞাননেত্রে তিনি যেন বিষ্ণুকে দর্শন করতে পারেন, তাঁর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন ; কর্মের উদ্দেশ্য সাধনে তিনি যেন সক্ষম হন।”
কেউ কেউ বিষ্ণুস্মরণ মন্ত্রের সঙ্গে আরও দুটি পংক্তি জুড়ে দেন—
ওঁ মাধবো মাধবো বাচি মাধবো মাধবো হৃদি।
স্মরন্তি সাধবঃ সর্বে সর্বকার্যেষু মাধব।।
মন্ত্রের অর্থ—
সাধুব্যক্তিদের বাক্যে মাধব (বিষ্ণু) ও হৃদয়ে মাধব। তাঁরা সকল কাজেই মাধবকে স্মরণ করে থাকেন।
ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু।
তান্ত্রিক আচমনঃ
ওঁ আত্মতত্ত্বায়
স্বাহা। ওঁ বিদ্যাতত্ত্বায় স্বাহা। ওঁ শিবতত্ত্বায় স্বাহা।
ক্রমে এই তিন মন্ত্রে তিনবার জলপান করিয়া আচমন করিবে।
স্বস্তিবাচন।
পরে গন্ধপুস্পাদি দ্বারা ব্রাহ্মণত্রয়ের পূজা করিয়া তাহাদিগের হস্তে তণ্ডুল প্রদানান্তর করযোড়ে পাঠ করিবে।
"ওঁ কর্ত্তব্যেহস্মিন্ অমুককর্ম্মণি - ওঁ পুণ্যাহং ভবন্তোব্রুবন্তু।" - ইহা তিনবার পাঠ করিবে।
ব্রাহ্মণগণও নিজ নিজ হস্তস্থিত আতপ চাউল পরিত্যাগ করিতে করিতে তিনবার পাঠ করিবেন -
ওঁ পুণ্যাহং ওঁ পুণ্যাহং ওঁ পুণ্যাহম্।
"ওঁ কর্ত্তব্যেহস্মিন্ অমুককর্ম্মণি - ওঁ স্বস্তি ভবন্তোব্রুবন্তু।" - ইহা তিনবার পাঠ করিলে পূর্ব্ববৎ আতপ চাউল বিকীর্ণ করিতে করিতে ব্রাহ্মণগণ তিনবার পাঠ করিবেন - ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি।
"ওঁ কর্ত্তব্যেহস্মিন্ অমুককর্ম্মণি - ওঁ ঋদ্ধিং ভবন্তো ব্রুবন্তু।" - ইহা পূর্ব্ববৎ তিনবার পাঠ করিলে ব্রাহ্মণগণ হস্তস্থিত চাউল পরিত্যাগ করিতে করিতে পাঠ করিবেন -
ওঁ ঋধ্যতাং ওঁ ঋধ্যতাং ওঁ ঋধ্যতাং। অনন্তর স্ববেদোক্ত স্বস্তিবাচন পাঠপূর্ব্বক আতপ তণ্ডুল নিক্ষেপ করিয়া এই মন্ত্র পাঠ করিবে, যথা -
"ওঁ কর্ত্তব্যেহস্মিন্ অমুককর্ম্মণি - ওঁ ঋদ্ধিং ভবন্তো ব্রুবন্তু।" ইহা পূর্ব্ববৎ তিনবার পাঠ করিলে ব্রাহ্মণগণ হস্তস্থিত চাউল বিকীর্ণ করিতে করিতে পাঠ করিবেন - ওঁ ঋধ্যতাং ওঁ ঋধ্যতাং ওঁ ঋধ্যতাম্। অনন্তর স্ববেদোক্ত স্বস্তিবাচন পাঠপূর্ব্বক আতপ তণ্ডুল নিক্ষেপ করিয়া এই মন্ত্রপাঠ করিবে, যথা -
ওঁ সূর্য্যঃ সোমো যমঃ কালঃ সন্ধ্যে ভূতান্যহঃ ক্ষপা। পবনো দিক্পতির্ভূমিরাকাশং খচরামরাঃ। ব্রাহ্মং শাসনমাস্থায় কল্পধ্বমিহ সন্নিধিম্।। ওঁ তৎসৎ অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু।।
স্ত্রী হইলে ""নমো নমঃ"" মাত্র বলিবে, পুরোহিতই মন্ত্র পাঠ করিবেন। যে ক্রিয়ার জন্য স্বস্তিবাচন, "অমুক কর্ম্মণি" স্থলে তাহার নাম উল্লেখ করিবে। এই স্বস্তিবাচন ত্রিবেদীয়েরাই করিতে পারেন। বেদোক্ত বিশেষ স্বস্তিবাচন মন্ত্র পৃথক্ লিখিতে হইল।©মন্ত্র শিক্ষা-"পুরোহিত দর্পণ"
সামবেদীয়-স্বস্তিবাচন।
ওঁ সোমং রাজানং বরুণমগ্নিমন্বারভামহে। আদিত্যং বিষ্ণুং সূর্য্যং ব্রহ্মাণঞ্চ বৃহস্পতিম্।। ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি।।
যজুর্বেদীয়-স্বস্তিবাচন।
ওঁ স্বস্তি ন ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ স্বস্ত্যি নঃ পূষা বিশ্ববেদাঃ। স্বস্তি নস্তার্ক্ষ্যোঅরিষ্টনেমিঃ স্বস্তি নো বৃহস্পতির্দধাতু।। ওঁ গণানাং ত্বা গণপতিগুং হবামহে, ওঁ প্রিয়াণাং ত্বা প্রিয়পতিগুং হবামহে, ওঁ নিধীনাং ত্বা নিধিপতিগুং হবামহে, বসো মম। ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি।।
ঋগবেদীয়-স্বস্তিবাচন।
ওঁ স্বস্তি নো মিমীতামশ্বিনা ভগঃ স্বস্তি দেব্যদিতিরনর্বণঃ। স্বস্তি পুষা অসুর দধাতু নঃ। স্বস্তি দ্যাবাপৃথিবী সুচেতনা।। ওঁ স্বন্তয়ে বায়ুমুপ ব্রুবামহৈ সোমং স্বস্তি ভুবনস্য যস্পতিঃ। বৃহস্পতিং সর্ব্বগণং স্বস্তয়ে স্বস্তয়, আদিত্যাসো ভবন্তু নঃ। ওঁ বিশ্বে দেবা নো অদ্যা স্বস্তয়ে, বৈশ্বানরো বসুরগ্নিঃ স্বস্তয়ে। দেবা অবন্ত্বভবঃ স্বস্তয়ে স্বস্তি নো রুদ্রঃ পাত্বংহসঃ। ওঁ স্বস্তি মিত্রাবরুণা স্বস্তি পথ্যে রেবতি স্বস্তি ন ইন্দ্রশ্চাগ্নিশ্চ স্বস্তি নো অদিতে কৃধি। ওঁ স্বস্তি পন্থামনু চরেম সূর্য্যাচন্দ্রমসাবিব পুনর্দ্দদতাঘ্নতা জানতা সং গমেমহি। ওঁ স্বস্ত্যয়নং তার্ক্ষ্যমরিষ্টনেমিং, মহদ্ভুতং বায়সং দেবতানাম্। অসুরঘ্ন-মিন্দ্রসখং সমৎসু বৃহদ্যশো নাবমিবা রুহেম।। ওঁ অংহো মুচমাঙ্গিরসং গয়ঞ্চ স্বস্ত্যাত্রেয়ং মনসা চ তার্ক্ষ্যং প্রযতপাণিঃ শরণং প্রপদ্যে স্বস্তি সংবাধেস্বভয়ং নো অস্তু।। ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি।
তান্ত্রিক-স্বস্তিবাচন।
হ্রীঁ হূঁ স্বস্তি নঃ কাত্যায়নী হ্রূং অপর্ণাশ্রবা হ্রূঁ স্বস্তি নঃ কালী হ্রৌং মেধামৃতময়ী হ্রীঁ স্বস্তি নঃ প্রত্যঙ্গিরা দেবতা দধাতু হ্রীঁ স্বস্তি হ্রীঁ স্বস্তি হ্রীঁ স্বস্তি।
তান্ত্রিক স্বস্তিসূক্তম্।
ওঁ সর্ব্বশ্চ দেবশ্চ বিভীতকঞ্চ
প্রভঞ্জতাং মেরুঃসুবর্ণদায়ী।
কালোদ্ধ মা মা সচেন্দ্রিয়াং শ্রিয়ো
বিবিক্তরাগাশ্চ পুনর্ভবায় বৈ।।
*************************************
তদ্বিঞ্চোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সুরয়ঃ।
দিবীব চক্ষুরাততম্।।
অর্থ -------- ধার্মিক জ্ঞানীরা দ্যুলোকের বিশাল চক্ষু সূর্যাদি ন্যায় সর্বব্যাপক পরমাত্মার সেই পরম পদ সন্দর্শন করেন।
ভাবার্থ -------- প্রাণী যেমন সূর্যের সাহায্যে শুদ্ধনেত্র দ্বারা মূর্ত্তিমান পদার্থকে দর্শন করে ধার্মিক বিদ্বানেরা শুদ্ধ জ্ঞাননেত্র দ্বারা তেমনই নিজের মধ্যে পরমাত্মার পরমপদ মোক্ষকে সন্দর্শন করেন।