বেদান্তে পরমব্রহ্মজ্ঞান এবং পরমমুক্তির(মোক্ষলাভ) জন্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ নির্ণয় করা আছে যদি কোন অজ্ঞানী বা সংসার আসক্তিতে বদ্ধজীবও ( মানুষ) এই অষ্টাঙ্গিক মার্গের রাস্তা সম্পূর্ণ করতে পারে তাহলে সেই ব্যাক্তি পরম ব্রহ্মজ্ঞান এবং পরমমুক্তি( মোক্ষলাভ) লাভ করতে পারবে। 1. শিক্ষা :- শাস্ত্রজ্ঞান , আচরন জ্ঞান , ব্যবহারবিধি, কর্মকাণ্ড ও জ্ঞান কান্ডের , গুরু আদেশ পালন ও সেবা জ্ঞান , শিষ্টাচার - শালীনতা জ্ঞান, কর্তব্য - অকর্তব্য জ্ঞান, ধর্ম-অধর্ম, ন্যায়-অন্যায় , বিবেক-বিচার জ্ঞান, এই ধরনের মানসিক এবং কর্মকাণ্ড ও জ্ঞান কান্ডের চারিত্রিক সামগ্রিক যে শিক্ষা তাকেই শাস্ত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রথমমার্গ “ শিক্ষামার্গ “বলা হয়। 2. গুরুকরন :- শাস্ত্রীয় 24 - 32 লক্ষণ যুক্ত মহাপুরুষের অনুসন্ধান করার পর তাঁর কাছে দীক্ষা প্রার্থনা করিতে হয়—-দীক্ষা প্রার্থনা করার পর যদি সেই মহাপুরুষের নিকট হইতে দীক্ষার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায় একে শাস্ত্র অনুসারে গুরুকরণ বলে ৷ অর্থাৎ সেই সিদ্ধ পুরুষ যদি কোন ব্যক্তিকে ভবিষ্যতে আধার ও সময় অনুসারে উপদেশ ও দীক্ষা দেবার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন সেই প্রতিশ্রুতি দেবার সময় বা সেই ক্ষণ থেকেই তাকে শাস্ত্র অনুসারে গুরুকরণ বলা হয় । কারণ ভবিষ্যতে উপদেশ ও দীক্ষা দেবার প্রতিশ্রুতি দেবার সময় বা সেই ক্ষণ থেকেই তাকে শাস্ত্র অনুসারে গুরু এবং শিষ্যের সম্পর্ক ধরা হয়— এইজন্য এই অবস্থাকে শাস্ত্র অনুসারে গুরুকরণ বলা হয় – যাহাকে শাস্ত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গের দ্বিতীয়মার্গ “গুরুকরণমার্গ” বলা হয়। 3. উপদেশ :- গুরুকরনের পর দীর্ঘদিন ধরে গুরুসঙ্গ, গুরুসেবা, সৎ-সঙ্গ, সাধুসেবা এবং ভবিষ্যতে সাধনার জন্য কি করনীয়, কি বা না-করনীয়, এরকম গূঢ় আধার বিশেষে যে উপদেশ গুরুর নিকট হইতে পাওয়া যায়, তাকে উপদেশ বলা হয় ৷ অর্থাৎ গুরু তার শিষ্যের আধার দেখে তার জন্য যে বিশেষ বিশেষ উপদেশ বা পরিচালনায় জন্য বক্তব্য রাখেন তাকেই শাস্ত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গের তৃতীয়মার্গ “উপদেশমার্গ “ বলা হয়। 4. অনুশাসন :- গুরুর নিকট হইতে আধারবিশেষে যে অনুশাসনের উপদেশ, বিচারের উপদেশ, করনীয় উপদেশ, কার্যের উপদেশ প্রাপ্ত হয়ে - সেই সব উপদেশগুলির এর সঙ্গে নিত্য-অনিত্য বিবেকবিচার এবং শাস্ত্রের 42 বৈদিক অনুশাসন বাস্তবিক জীবনে কায়-মন-বাক্যে 100% প্রতিপালন করার নাম অনুশাসন – যাহাকে শাস্ত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গের চতুর্থমার্গ “ অনুশাসনমার্গ” বলা হয়। 5. দীক্ষা :- গুরুর দেওয়া উপদেশগুলির এর সঙ্গে নিত্য-অনিত্য বিবেকবিচার এবং শাস্ত্রের 42 বৈদিক অনুশাসন বাস্তবিক জীবনে কায়-মন-বাক্যে 100% প্রতিপালন এবং করনীয় কর্তব্য কর্মের সম্পূর্ণভাবে প্রতিপালন করতে করতে নামদীক্ষা এবং বীজদীক্ষা ও গায়ত্রীদীক্ষা তৎপরে পশুভাব সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হইলে যোগদীক্ষা এবং যোগদীক্ষার সাধনা করতে করতে সাধনার উত্তমস্তরে এলে ব্রহ্মবিদ্যাদীক্ষা লাভ হয় । এই সমস্ত দীক্ষার স্তর গুলি ক্রমান্বয়ে যোগ্যতা অনুসারে প্রাপ্ত করাকে বৈদিক মতে দীক্ষা প্রাপ্তি বলে । তবে বিশেষ বক্তব্য যে গুরু উপদেশ এর সঙ্গে সঙ্গে নামদীক্ষা এবং বীজদীক্ষা ও গায়ত্রীদীক্ষা প্রাপ্তি অতি প্রয়োজন কারণ এগুলি প্রাপ্ত না হলে কেউ গুরু সঙ্গে আন্তরিক ভাবে যুক্ত হতে পারেনা , তাই সাধনার প্রাথমিক স্তরে অনুশাসন এবং উপদেশ স্তরেও এই দুধরনের দীক্ষা অত্যন্ত আবশ্যক , আরো কারণ হইলো যে দীক্ষা ব্যতীত শাস্ত্রীয় কোন কর্মের অধিকার কেউ প্রাপ্ত হয় না সেই কারণে গুরুকরণ এবং দীক্ষার অধিকার আবশ্যকতার কথা শাস্ত্রে বারবার বলা হয়েছে– যাহাকে শাস্ত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গের পঞ্চমমার্গ “ দীক্ষামার্গ” বলা হয়। 6. সাধনা :- হৃদয় এবং ভাবগত ভাবেঅন্তর থেকে পশুভাব সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হবার পর এবং মনুষ্য ভাবে স্থিতির পর যোগদীক্ষা প্রাপ্তির পর সাধনা শুরু হয় এবং এই সাধনার দ্বারা এবং তার সঙ্গে গুরু সেবা এবং গুরুর প্রতিটি আদেশ প্রতিপালন এবং নিত্য-অনিত্য বিচার সহকারে 42 বৈদিক অনুশাসন পূর্ণরূপে(বাস্তবিক জীবনে কায়মনোবাক্যে) পালন করলে ক্রমান্বয়ে মনুষ্যভাব থেকে দেবভাব, দেবভাব থেকে ব্রহ্মভাব লাভ করা পর্যন্তই একেই সাধনার সাধনাস্তর বলা হয় – যাহাকে শাস্ত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গের ষষ্ঠমার্গ “ সাধনামার্গ” বলা হয়। 7. স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থা :- যোগ দীক্ষা এবং অনুশাসিত জীবন যাপনের ফলে যখন কোনো মনুষ্য ব্রহ্ম ভাবে আসে (ব্রহ্মভাব লাভ করে) তখন সেই ব্যক্তির অন্তরে সর্বদা সাম্য ভাব বিদ্যমান থাকে । এই অবস্থা কে স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থা বলে এবং এই অবস্থাতেই বা এই স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থা লাভ করার পরে গুরুর কাছে ব্রহ্মবিদ্যাদীক্ষা প্রাপ্তি হওয়ার যোগতা লাভ করে – যাহাকে শাস্ত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গের সপ্তমমার্গ “স্থিতপ্রজ্ঞমার্গ” বলা হয়। 8. সিদ্ধঅবস্থা : - স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থা লাভ করার পর গুরুর কাছে ব্রহ্মবিদ্যাদীক্ষা লাভের পর - ব্রহ্মবিদ্যার গুহ্যবিদ্যা সাধনার দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করে কোন ব্যক্তি প্রথম সিদ্ধঅবস্থা বা সিদ্ধপুরুষ অবস্থা প্রথম লাভ করে এবং আত্মজ্ঞানরুপি প্রথম সিদ্ধপুরুষঅবস্থা লাভ করার পর ক্রমান্ধয়ে - আধার, ভাব এবং সময় অনুসারে সাধক/ যোগী পরা-প্শন্তি-মধ্যমা নাদ জ্ঞান–সবিকল্প সমাধি- ঈশ্বরদর্শন - ঈশ্বরস্বরূপ দর্শন -পরমাত্মজ্ঞান - সৃষ্টিস্থিতিলয় জ্ঞান, কালচক্র জ্ঞান , কর্মবীজ ও কর্মতত্ত্বজ্ঞান , ক্রমান্বিত দিব্যচক্ষু লাভ- ব্রহ্মজ্ঞান লাভ - ব্রাহ্মীস্থিতি ( নির্বিকল্পসমাধি ) - নির্বীজসমাধি - পূর্ণ জীবনমুক্ত অবস্থা লাভ করে পরম সিদ্ধমহাপুরুষ / সিদ্ধমহাপুরুষযোগী অবস্থা প্রাপ্ত হয় ৷ আধার, ভাব এবং সময় অনুসারে সাধক ক্রমান্বয়ে সিদ্ধঅবস্থার এক- এর পর এক স্তর অতিক্রম করে সম্পূর্ণ জীবনমুক্ত অবস্থা লাভ করিতে সমর্থ হয় —-- যাহাকে শাস্ত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গের অষ্টমমার্গ “সিদ্ধঅবস্থামার্গ” বলা হয়।
ইহাকেই বৈদান্তিক অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলে ৷ যার মাধ্যমে যে কোনো সাধারণ অজ্ঞানী বা সংসার আসক্তিতে বদ্ধজীবও ( মানুষ) পরমব্রহ্মজ্ঞানী এবং সম্পূর্ণ জীবনমুক্ত পুরুষ অবস্থা লাভ করিতে পারে ৷