কৃপা
শুধু কোন বই বা পুস্তক পড়ে আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা সম্বন্ধে কিঞ্চিত মাত্র জ্ঞান হয় না কারণ এটি সম্পূর্ণ গুরুমুখী বিদ্যা !
শাস্ত্রে চার ধরণের কৃপা শক্তির কথা উল্লেখ করা আছে। যথা - ১. আত্ম কৃপা ২. শাস্ত্র কৃপা ৩. গুরু কৃপা ৪. ঈশ্বরীয় কৃপা।
১. আত্ম কৃপা :- যে ব্যাক্তি নিজের মুক্তির জন্য বা নিজের আত্মজ্ঞানের জন্য বা ঈশ্বর লাভের জন্য প্রবলভাবে আকুল -ব্যাকুল হয় এবং আত্মজ্ঞান বা মুক্তি বা পরমাত্মা লাভের জন্য রাস্তা পাবার মহা আকুলতা তৈরী হয় তাকে আত্মকৃপা বলে। অর্থাৎ নিজের ভালোর জন্য বা নিজের কল্যাণের জন্য বা নিজের মুক্তির জন্য যে নিজে জাগরুক হয় বা নিজেকে কৃপা করে তাকে বলা হয় আত্মকৃপা। তাই একটি বিশেষ কথা যে নিজের কল্যাণ বা নিজের ভালো বা নিজের মুক্তি জন্য নিজেকে কৃপা না করে অর্থাৎ যে নিজের ভালো নিজে না চায় তাঁর ভালো কোনো ঈশ্বরীয় শক্তি বা কোনো গুরুশক্তি তাঁর কল্যাণ করতে পারে না। তাই আত্মউন্নতির পথে আত্ম কৃপা অতি প্রয়োজন।
২. শাস্ত্র কৃপা :- যখন কোনো ব্যাক্তি আত্ম কৃপা করে তখন সেই ব্যাক্তি ঈশ্বর লাভ বা আত্মজ্ঞানের জন্য আকুল হয়ে উপায় বা পথ খুঁজতে আরম্ভ করে তখন প্রথম পথ দেখায় শাস্ত্র। শাস্ত্র শিক্ষা দেয় যে গুরু ছাড়া মার্গ দেখাবার কেউ থাকে না , তাই গুরু করুন অতি আবশ্যক। কিন্ত গুরু কিভাবে চিনিবে ? - সদ গুরুর লক্ষন কি ? কিভাবে গুরু লাভ করিবে ? কিভাবে গুরুর সেবা করিবে ? কিভাবে আচরণ করিবে ? ধর্ম কাকে বলে ? জ্ঞান কাকে বলে ? আত্মজ্ঞান কাকে বলে ? পরমাত্ম জ্ঞান কাকে বলে ? ব্রহ্ম জ্ঞান কাকে বলে ? মোক্ষলাভ কাকে বলে ? কাল কাকে বলে ? বিদ্যা কাকে বলে ? প্রমান প্রত্যমেয় - প্রতিমেয় কাকে বলে ? ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি - স্থিতি -লয় কারক কি ? নিত্যত্ব সনাতন কাকে বলে ? গুন্ কাকে বলে ? দুঃখ কাকে বলে ? যাবতীয় সমস্ত শিক্ষা, পরোক্ষ জ্ঞান শাস্ত্র প্রদান করে। তাই সমস্ত জ্ঞানের , পরোক্ষ জ্ঞানের আকর হলো শাস্ত্র। তাই শাস্ত্রজ্ঞান ব্যাতিত গুরুলাভ এবং গুরু আচরণ করতে পারে না। তাই শাস্ত্র জ্ঞানকেই শাস্ত্র কৃপা বলে, তাই শাস্ত্র কৃপা ব্যাতিত এর পরবর্তী ধাপ গুরু কৃপা লাভ করতে পারে না।
৩. গুরু কৃপা :- পূর্বে শাস্ত্র অনুসারে চলে গুরু লাভ হবার পর কায়-মন বাক্যে গুরু সেবা বা গুরু উপদেশ বা গুরু আদেশ পালন করে ক্রমান্বয়ে গুরুর সন্তুষ্টি উৎপন্ন করতে হয় এবং নিজের আধারের এবং ভাবের শুদ্ধি করতে হয়। দীর্ঘ দিন এইভাবে করতে করতে যখন শিষ্যের আধার পরম শুদ্ধি হয় ও গুরুও শিষ্যের আচরণে সন্তুষ্টি হন তখন গুরু কৃপা করে শিষ্যকে পরম বিদ্যা প্রদান করেন এবং গুরু শিষ্যকে সর্বদা দৃষ্টি রাখিব এই প্রতিশ্রুতি দেন। এইরকম গুরু কৃপা লাভ করিয়া শিষ্য পরমাত্মজ্ঞানে পরাকাষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হয় এবং পরম ঈশ্বর লাভের সন্নিবেশ প্রাপ্ত হন। ইহাই পরম গুরু কৃপা।
৪. ঈশ্বরীয় কৃপা : - গুরুর কৃপায় সমৃদ্ধ শিষ্য যখন আত্মজ্ঞান ও সৎ পরমাত্মজ্ঞান লাভ করে এবং সে সৎ পরমেশ্বরকে দর্শন লাভ হয়। জীবাত্মা -পরমাত্মায় যুক্ত করার জন্য তখন সে পরমেশ্বর এর চরণে যুক্ত হবার জন্য পরমভক্তি সহকারে আকুল -ব্যাকুল ভাবে প্রার্থনা করতে থাকে। তখন পরমাত্মা কৃপা করে জীবাত্মাকে যুক্ত করে নিয়ে পরম ব্রহ্ম স্থিতি প্রদান করেন। ইহাকেই ঈশ্বরীয় কৃপা বলে।
উপসংহার :- যেকোনো মনুষ্য ক্রমান্বয়ে আত্ম কৃপা - শাস্ত্র কৃপা - গুরু কৃপা -ঈশ্বরীয় কৃপা এই চতুর কৃপা লাভ করে পরমজ্ঞান এবং পরমমুক্তি লাভ করে।
************************************************************************
গুরুর কৃপা, গুরুর আশীর্ব্বাদ ও গুরুর শুভদৃষ্টি লাভই গুরুদর্শন। গুরুর নির্দ্দেশ মত চলা, গুরুর আদেশ উপদেশ প্রতিপালন ও তাঁহার নির্ণীত নির্দ্ধারিত পথে চলার দ্বারাই গুরুকৃপা লাভ হইয়া থাকে।
গুরুর আদেশকেই শিষ্য একমাত্র মন্ত্র বলিয়া জানিয়া মানিয়া চলিবে। শিষ্য গুরুকে সতত যেরূপ চক্ষে দেখিয়া থাকে, তাঁহার আদেশকেও সর্ব্বদা সেইরূপ চক্ষে দেখিয়া বুঝিয়া মানিয়া চলিবে।
গুরুর আদেশই শিষ্যের একমাত্র সহায় ও সম্বল।
শিষ্যের যাবতীয় বিভ্রম-বিভ্রান্তি-বিস্মৃতির ঘোর ভাঙ্গিয়া, মায়ামোহ-বাসনার জালকে ছিন্নভিন্ন
করিয়া, যাবতীয় দুঃখ-দৈন্য-দুর্ব্বলতাকে দূর করিয়া এই আদেশই শিষ্যকে সব সময় জাগ্রত, জীবন্ত ও সজাগ রাখিবে; সুতরাং এই আদেশকে সতত স্মরণ মননে নিদিধ্যাসনে রাখাই শিষ্যের একমাত্র সাধনা।
মনকে সর্ব্বদা গুরুমুখী করিয়া রাখাই শিষ্যের একমাত্র তপস্যা ও আরাধনা। সব রকম কাজের ভিতর দিয়া চলাফেরার সঙ্গে সঙ্গে বহির্মুখী মনকে গুরুমুখী করিয়া রাখিতে পারিলে বাহিরের কোন রকম বাজে আবহাওয়া শিষ্যকে কোন ভাবে কোন রকমে ধরিতে ছুঁইতে স্পর্শ করিতে পারিবে না।
এই বিধান সব সময় মানিয়া চলিলে শিষ্য আর কখনও কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইবে না।
চন্দ্র-সূর্য্য-গ্রহ-নক্ষত্র প্রভৃতি দিক্পালকে সাক্ষী রাখিয়া, অগ্নি ও গুরুকে স্পর্শ করিয়া আমি যে সুমহান্ ব্রত ও নিয়ম গ্রহণ করিয়াছি, আমার ধমনীতে এক বিন্দু রক্ত থাকিতেও সেই ব্রত ও নিয়ম লঙ্ঘন করিব না। গুরুর আদেশ প্রতিপালনেই শিষ্যের জন্মজন্মান্তরীণ যাবতীয় বাসনার নাশ হইয়া থাকে।