প্রশ্ন :- শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির কাছে প্রকৃত শাস্ত্র জ্ঞান লাভের পর কী করা উচিত ?

উত্তর :- মনুষ্য জীবনে শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির কাছে প্রকৃত শাস্ত্র জ্ঞান লাভের পর কী করা উচিত এটি নিয়ে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ শ্রীমদভগবৎ গীতা 4 নং অধ্যায় 34 নং শ্লোকে সম্পূর্ন নির্দেশ দিয়েছেন যে -

                      তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া ৷ 

                     উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ || গীতা 4/34

অনুবাদঃ তুমি প্রথমে তত্ত্বদ্রষ্টা সদগুরু জ্ঞানী পুরুষ এর কাছে যাও - তারপর তাদের কায়মনোবাক্যে হৃদয় থেকে অকৃত্রিম ভাবে সেবা করো, তারপর যখন তোমার কায়মনোবাক্যে হৃদয় থেকে অকৃত্রিম  সেবায় সেই তত্ত্বদ্রষ্টা সদগুরু  জ্ঞানী পুরুষ অত্যন্ত তুষ্টি লাভ করবেন, তখন সেই তত্ত্বদ্রষ্টা সদগুরু  জ্ঞানী পুরুষকে শিক্ষা-দীক্ষা-বিদ্যা বিষয়ক প্রশ্ন করো । তখন সেই তত্ত্বদ্রষ্টা সদগুরু জ্ঞানী পুরুষ তোমাকে জ্ঞান উপদেশ দান করবেন। (গীতা 4/34)

                 যজজ্ঞাত্বা ন পুনর্মোহমেবং যাস্যসি পান্ডব। 

                যেন ভূতান্যশেষাণি দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি।। গীতা 4/35

অনুবাদঃ হে পান্ডব! এভাবে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে তুমি আর মোহগ্রস্ত হবে না, কেন না এই জ্ঞানের দ্বারা তুমি দর্শন করবে যে, সমস্ত জীবই আমার বিভিন্ন অংশ অর্থাৎ তারা সকলেই আমার এবং তারা আমাতে অবস্থিত। (গীতা 4/35)

                   অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ।

                   সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি।।গীতা 4/36

অনুবাদঃ তুমি যদি সমস্ত পাপীদের থেকেও পাপিষ্ঠ বলে গণ্য হয়ে থাক, তা হলেও এই জ্ঞানরূপ তরণীতে আরোহণ করে তুমি দুঃখ-সমুদ্র পার হতে পারবে। (গীতা 4/36)

শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির কাছে শাস্ত্র জ্ঞান লাভ করার পর এবং কোনটি কর্তব্য এবং কোনটি  অকর্তব্য এই নির্ণায়ক সদবুদ্ধি লাভ করার পর তত্ত্বদ্রষ্টা সদগুরুকরণ প্রত্যেকের আত্মজ্ঞান লাভের জন্য অতি আবশ্যক এবং উচিত।

                    শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ। 

                    জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি।।গীতা 4/39

অনুবাদঃ সংযতেন্দ্রিয় ও তৎপর হয়ে চিন্ময় তত্ত্বজ্ঞানে এবং তত্ত্বদ্রষ্টা সদগুরুর উপর শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি এই আত্মতত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন। সেই দিব্য আত্মতত্ত্বজ্ঞান লাভ করে তিনি অচিরেই পরা শান্তি প্রাপ্ত হন। (গীতা 4/39)

                    অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি। 

                     নায়ং লোকোহন্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ।।গীতা 4/40

অনুবাদঃ অজ্ঞ ও শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি কখনই দিব্য আত্মতত্ত্বজ্ঞান এবং ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে না। সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির ইহলোকে  সুখ-শান্তি প্রাপ্ত হন না এবং পরলোকেও মুক্তি ও সুখ-শান্তি প্রাপ্ত হন না।

(গীতা 4/40)

তাই সদগুরু এবং শাস্ত্রের উপর পরম শ্রদ্ধাবান যে কোন ব্যাক্তি- গুরুর দানকরা দীক্ষা- শিক্ষা-বিদ্যা-উপদেশে দিব্য আত্মতত্ত্বজ্ঞান এবং ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে । তাই শাস্ত্রের উপর পরম শ্রদ্ধা রেখে গুরুর প্রতিটি আদেশ পালনে যে কোন ব্যাক্তি দিব্য জ্ঞান লাভ করতে পারে তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত গুরুর প্রতিটি আদেশ ভগবত আদেশ পালন করে চলা ।

প্রশ্ন :-শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির কাছে শাস্ত্র জ্ঞান লাভ করার পর এবং কোনটি কর্তব্য এবং কোনটি  অকর্তব্য এই নির্ণায়ক সদবুদ্ধি লাভ করার পর– কিন্তু কে সদগুরু বা কে প্রকৃত সদগুরু হবার যোগ্য এটি সম্বন্ধে শাস্ত্রের কি  মতামত বা আমরা প্রকৃত সদগুরু কিভাবে চিনব ?

উত্তর :- একজন মহান আত্মজ্ঞানী মানুষের শরীরের ওপর তার কঠোর সাধনা  করার জন্য  আপনা-আপনি কিছু শাস্ত্রীয় লক্ষণ প্রকাশিত হয় —ভগবান শিবের পুত্র ভগবান কার্তিকেয় আত্মজ্ঞানী মহাপুরুষের কিছু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রীয় লক্ষণ এর উপর একটি শাস্ত্র রচনা করেছিলেন । এই শাস্ত্রের কথা ঋষিদের মাধ্যমে বিশ্বের বহু মানুষ জানতে পারে। এই শাস্ত্রে আত্মজ্ঞানী মহাপুরুষের কিছু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রীয় লক্ষণ এর কথা বলা হয়েছে। এই শুভ চিহ্নগুলি যদি শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে থাকে তাহলে জানতে হবে যে সেই ব্যক্তি  অবশ্যই ভাগ্যবান ও মহান আত্মজ্ঞানী মহাপুরুষ। শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির কাছে শাস্ত্র জ্ঞান লাভ করার  সময় এই লক্ষণগুলি সম্বন্ধে শিক্ষা গ্রহণ করা বিশেষভাবে উচিত । যদি আমরা শাস্ত্রের এই লক্ষণগুলি সম্বন্ধে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তাহলে অবশ্যই এই লক্ষণ দেখে আমরা - কে মহাপুরুষ আর কে মহাপুরুষ নয় এটি জানতে সমর্থ হব এবং সেই অনুসারে আমরা অবশ্যই সৎগুরু করণ করতে পারব  ।  তাই শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির কাছে শাস্ত্র শিক্ষা গ্রহন কালে এই শাস্ত্রীয় মহাপুরুষ চেনা লক্ষণগুলি শিক্ষা করা অত্যন্ত আবশ্যক প্রত্যেকের জন্য।

যার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপরোক্ত শাস্ত্রীয় লক্ষণসমূহ থাকবে তিনি অবশ্যই আত্মজ্ঞানই মহাপুরুষ যার থাকবে না সে অবশ্যই আত্মজ্ঞানী মহাপুরুষ নয় এটা জেনেই আমরা সদ্গুরু চিনিবার পথে চলতে সমর্থ হব  । তাই গুরু করনের আগে লক্ষণ বিচার করেই সদ্গুরু করন করতে হয় আর যদি এরকম কেউ না করে অথচ গুরু করণ করে তার জীবনে ভন্ড গুরু পাল্লায় পড়ে জীবনের আধ্যাত্বিক পথ এবং জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট হবার ভয় অতিমাত্রায় থাকে । তাই শাস্ত্র অনুসারে চলে লক্ষণ বিচার করে আত্মজ্ঞানই মহাপুরুষ কিনা জেনে তারপর তার চরণে গিয়ে সদ্গুরু করণ করতে হয় এটাই শাস্ত্র সিদ্ধান্ত । 

নিজে নিজে বই পড়ে শাস্ত্রীয় লক্ষণসমূহ শেখা সম্ভব নয় ,- তাই কোন শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির কাছে শাস্ত্র জ্ঞান লাভ করার  সময় প্রত্যক্ষ রূপে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত ।

প্রশ্ন:-  কোনো আত্মজ্ঞানী সাধক বা যোগীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ সম্বন্ধে প্রার্থনা করার পূর্বে শিষ্যরূপী ব্যাক্তির কি করা উচিত ?

উঃ- কোনো আত্মজ্ঞানী সাধক বা যোগীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ সম্বন্ধে প্রার্থনা করার পূর্বে - শিষ্যরূপী ব্যাক্তির নিজেকে যাচাই করা উচিত।  যথা :-

1. গুরুরূপী ব্যাক্তির সম্বন্ধে কোনোরূপ সন্দেহ বা দ্বন্দ্ব -দ্বিধা আছে কিনা।

2. গুরুরূপী ব্যাক্তির চরিত্র - আচরণ - ব্যাক্তিত্ব সম্বন্ধীয় কোনো অমিল বা দ্বন্দ্ব বা অবিচার হচ্ছে কি না সেটা নিজের মধ্যে চিন্তন করা উচিত।

3. গুরুরূপী ব্যাক্তির আচরণ - স্বভাব - বাক্য - ব্যবহার, চাল- চলন , তাঁর বাহ্যিক জীবনধারাকে মানিয়ে নিয়ে অন্তঃকরণ থেকে শ্রদ্ধা -ভক্তি -বিনয় -নম্রতা আদেশ পালনের ক্ষমতা পূর্ণ মাত্রায় কায় - মন বাক্যে পালন করার যোগ্যতা শিষ্যরূপী ব্যাক্তির নিজের মধ্যে আছে কি না নিজেকে যাচাই করা উচিত।

4.  গুরুরূপী ব্যাক্তির শাস্ত্রীয় সমস্ত আত্মজ্ঞানই লক্ষণ আছে কিনা যাচাই করা উচিত। 

মূলতঃ আত্মজ্ঞানী সাধকের কাছে দীক্ষা প্রার্থনা করার পূর্বে শিষ্যরূপী ব্যাক্তির নিজের অন্তঃকরণকে  নিজে যাচাই করে গুরুরূপী ব্যাক্তির উপর সর্বকালে -সর্বপরিস্থিতিতে - সর্বস্থানে পূর্ণ শ্রদ্ধা - পূর্ণ বিশ্বাস - পূর্ণ নম্রতা - পূর্ণ বিনয় -পূর্ণ রূপে আদেশ পালনের ক্ষমতা যদি লাভ হয়ে থাকে তারপরই কোনো আত্মজ্ঞানী সাধকের কাছে দীক্ষা প্রার্থনা করা উচিত।

               উপরোক্ত আচরণ গুরুরূপী ব্যাক্তির ওপর শিষ্যরূপী ব্যাক্তির যদি অভাব থাকে বা পূর্ণরূপে  পালন করার ক্ষমতা না থাকে , তাহলে ততদিন পর্যন্ত দীক্ষা প্রার্থনা করা উচিত নয়।

       শিষ্যরূপী ব্যাক্তির নিজেকে পূর্ণ যাচাই -এর পর বেদান্ত অনুসারে উপরোক্ত যোগ্যতা লাভের পরই দীক্ষা প্রার্থনা করা উচিত।

১৷ কখনো রুঢ় ভাষা প্রয়োগ করবে না ৷

২৷ অতিরিক্ত ঘুমাবে না বা জেগে থাকবে না ৷

৩৷ দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করবে না এবং প্রস্রাব করার পর জল ব্যবহার করবে ৷

৪৷ পায়খানা করার পর স্নান করবে ৷

৫৷ কখনো কারো কিছু চুরি করবে না ৷

৬৷ কাউকে ব্যঙ্গ করবে না ৷

৭৷ মুখ না ঢেকে হাঁচ্চি বা হাই তুলবে না ৷

৮৷ বয়োজোষ্ঠ ব্যক্তির সামনে পা ছড়িয়ে বসবে না ৷

৯৷ কখনো কারো ক্ষতি করবে না বরং উপকার করার চেষ্টা করবে ৷

অসৎ শাস্ত্র পাঠ বা অধ্যয়ন করবে না ৷

১০৷ অন্ধ, বোকা, পীড়িত, কুৎসিৎ, খোড়া ও পতিত লোককে আঘাত করবে না ৷

১১৷ কোরা মাথায় আঘাত করবে না ৷

১২৷ কোলের উপর রেখে কোন কিছু খাবে না ৷

১৩৷ কেউ যদি অপমান করে, তাকে তিরস্কার করবে না বরং বোঝাবে, যদি না বোঝে তবে সেই স্থান ত্যাগ করবে ৷

১৪৷ খাওয়া বা পান করার জন্য ডান হাত ব্যবহার করবে ৷

১৫৷ কারো নিকট যাতে কোনরূপ অপরাধ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে ৷

১৬৷ ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে হাত-পা ভাল করে ধোয়ে নিবে ৷

১৭৷ সকালে ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নাম, মাতা, পিতা, গুরুকে প্রণাম করবে ৷

১৮৷ সকল রকম যৌন বাসনা ত্যাগ করবে ৷

১৯৷ কাউকে চরন স্পর্শ করে প্রণাম করবে না ৷

২০৷ মহিলারা মাতৃসুলভ আচরণ করবে ৷

২১৷ প্রতিদিন সূর্যোদয়ের দেড় ঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠবে ৷

২২৷ রাতে ছয় ঘন্টার বেশি ঘুমাবে না ৷

২৩৷ বামদিকে পাশ ফিরে অথবা চিৎ হয়ে শোবে কিন্তু কখনোই উবু হয়ে শোবে না

২৪৷ ভগবানের সমতুল্য কাউকে মনে করবে না ৷

২৫৷ অতিমাত্রায় ভোজন করবে না ৷

২৬৷ আমিষ আহার, নেশাদ্রব্য, অবৈধ স্ত্রী সঙ্গ, জুয়া খেলা বর্জন করবে ৷

২৭৷ প্রতিদিন মাতা পিতা ও আচার্যের সেবা করবে ৷

২৮৷ সন্ধ্যা বেলায় ভোজন, গমন ও নিন্দ্রা বা শয়ন করবে না ৷

২৯৷ ভোজনের পর স্নান করবে না ৷

৩০৷ সত্য কথা বলবে কিন্তু অপ্রিয় সত্য বলবে না।