ত্রিপুষ্কর দোষ কি?
একপাদ বা এক-পুষ্কর দোষ, দ্বিপাদ বা দ্বি-পুষ্কর দোষ এবং ত্রিপুষ্কর বা চরপাদ দোষ — এগুলোর প্রতিকার ব্যবস্থা বহু প্রাচীনকাল থেকেই শাস্ত্রে নির্ধারিত।
যদিও জন্ম ও মৃত্যু সম্পূর্ণই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতি সত্ত্বেও মানবজীবনের সব অধ্যায়কে মানুষ পরিচালনা করতে পারে না। তাই এখানেই স্বীকার করতে হয়—
“জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যু ধ্রুবং জন্ম মৃত্যুঃ চ।”
অর্থাৎ জন্ম ও মৃত্যু—এই দুই ঘটনাই অবশ্যম্ভাবী।
কাল জীব সৃষ্টি করে এবং কালই জীবের সংহার করে। এই অনিবার্য কালের প্রভাবে ঋষিগণ জ্যোতিষশাস্ত্রের মাধ্যমে শুভ–অশুভ সময় নির্ণয় করেছেন। জন্ম-মৃত্যু যেহেতু মানুষের হাতে নেই, তাই সে সময়ের শুভাশুভ ফল কালেরই নির্ধারিত।
বার–তিথি–নক্ষত্রে পুষ্করের যোগ
জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে—
শনিবার, রবিবার ও মঙ্গলবার,
দ্বিতীয়া, সপ্তমী, দ্বাদশী তিথি,
পুনর্বসু, উত্তরাষাঢ়া, কৃত্তিকা, উত্তরফল্গুনী, পূর্বভাদ্রপদ ও বিশাখা নক্ষত্র
—এগুলোকে পুষ্কর বলা হয়।
বার, তিথি ও নক্ষত্রের এই তিনটি পুষ্করের যোগ একত্রে ঘটলে তাকে ত্রিপুষ্কর বলা হয়।
একটি যোগ হলে—একপুষ্কর
দুটি যোগ হলে—দ্বিপুষ্কর
তিনটি যোগ হলে—ত্রিপুষ্কর বা চরপাদ।
ত্রিপুষ্কর জন্মে জাতককে শাস্ত্রে জারজ বলা হয়েছে, এবং এই যোগে করা কোনো কাজ তিনগুণ প্রভাব ফেলে—শুভ হলে তিনগুণ শুভ, অশুভ হলে তিনগুণ অশুভ।
শাস্ত্রে বলা আছে—
ত্রিপুষ্কর যোগে যেকোনো শুভ বা অশুভ কাজের ফল তিনগুণ হয় এবং এই যোগে সমগ্র গৃহ ও আত্মীয় পরিজন পর্যন্ত দুঃখে আক্রান্ত হতে পারে।
বার–তিথি–নক্ষত্র দোষের পৃথক প্রভাব
বারদোষে শস্য ও সন্তানহানি ঘটে।
তিথিদোষে গবাদি পশুহানি হয়।
নক্ষত্রদোষে বংশ, এমনকি বাড়ির বৃক্ষ পর্যন্ত নষ্ট হয়।
আর তিনটির সমন্বয়ে—ত্রিপুষ্কর দোষ—মা, বাবা, ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-স্ত্রী—যে কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এক বছরের মধ্যে কষ্টভোগ করতে বাধ্য হয় ।
এর প্রভাব কী?
1. শুভ কাজ: বিনিয়োগ, সোনা বা জমি কেনা, বাড়ি নির্মাণ শুরু করার মতো কাজে করলে তা তিনগুণ ফল দিতে পারে।
2. অশুভ কাজ: বিবাহ, ঋণ গ্রহণ বা প্রদান, সম্পত্তি বিক্রয় বা চুক্তি স্বাক্ষর—এই ধরনের কাজ করলে তা তিনবার পুনরাবৃত্তি হতে পারে (যেমন, একটি সম্পর্ক ভেঙে গেলে তিনবার ভাঙা) এবং এটি এড়িয়ে চলা উচিত।
'ত্রিপুষ্কর' নামের অর্থ:
'ত্রিপুষ্কর' অর্থ 'তিনটি পদ্ম'। পদ্ম যেমন সৃষ্টি, প্রাচুর্য ও পবিত্রতার প্রতীক, তেমনই এই যোগও তিনগুণ ফল দেয়, যা সম্পদ বৃদ্ধি বা দ্বিগুণ ক্ষতির কারণ হতে পারে। জ্যোতিষশাস্ত্রে এটি এক প্রকার 'মালাফিক' (Malefic) বা অশুভ যোগ হিসেবেও বিবেচিত, যার কারণে অনেকে এতে বড় কাজ করা থেকে বিরত থাকেন।
ত্রিপুষ্কর দোষ এর প্রতিকার কি ?
ত্রিপুষ্কর দোষ হলো কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর সময় তিথি, বার ও নক্ষত্রের অশুভ যোগ, যার ফলে অনুরূপ অশুভ ঘটনা তিনবার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকে ।
***এর মূল প্রতিকার হলো অভিজ্ঞ পণ্ডিত দ্বারা শাস্ত্রীয় "পুষ্কর শান্তি পূজা" বা হোম-যজ্ঞ করা ।
***এছাড়া মৃতব্যক্তির শবের সাথে বিশেষ পুত্তলিকা দাহ করাও একটি বিধান ।
ত্রিপুষ্কর দোষের বিস্তারিত প্রতিকার ও বিধানসমূহ:-------
1. শান্তি পূজা ও যজ্ঞ: দোষের প্রভাব কমাতে উপযুক্ত তিথি ও নক্ষত্র দেখে যোগ্য ব্রাহ্মণ বা গ্রহবিপ্র দ্বারা 'পঞ্চস্বস্ত্যয়ন বা পুষ্কর শান্তি' পূজা বা যজ্ঞ সম্পন্ন করতে হবে ।
2. পুত্তলিকা দাহ: শাস্ত্র অনুযায়ী, ত্রিপুষ্কর দোষে মৃত্যু হলে প্রধান মৃতদেহের সাথে কুশ বা কোনো পবিত্র উপাদান দিয়ে তৈরি তিনটি বা পাঁচটি পুত্তলিকা (পুতুল) একসাথে দাহ করা হয়, যাতে অশুভ প্রভাব ঐ পুতুলের ওপর পড়ে ।
3. শিব পূজা: দোষ প্রশমনে নিয়মিত শিবলিঙ্গে জল, দুধ নিবেদন এবং "ওঁ নমঃ শিবায়" মন্ত্র জপ করা শুভ বলে গণ্য করা হয় ।
4. দান ধ্যান: মৃত্যু-পরবর্তী নির্দিষ্ট সময়ে দান ও যোগ্য ব্যক্তিকে অন্নদান করলে দোষের তীব্রতা হ্রাস পায় । দরিদ্র মেয়েদের সাহায্য করা, হাসপাতালে ওষুধ দান করা এবং অভাবী মানুষকে অন্নদান করা এই দোষের নেতিবাচক প্রভাব কমায় ।প্রতিদিন গরুকে রুটি খাওয়ানো অত্যন্ত শুভ বলে বিবেচিত হয় ।অমাবস্যা বা পূর্ণিমার দিনে নিজের পূর্বপুরুষদের নামে খাবার, ফল বা অর্থ মন্দিরে দান করুন ।
5. নিয়মিত হনুমান চালিশা পাঠ করা বা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ করা মানসিক শান্তি ও দোষ মুক্তি নিশ্চিত করে ।
6. অশ্বত্থ গাছ (রবিবার বাদে) বা বটগাছে জল অর্পণ করা ভালো ।
7. প্রতিদিন সূর্যকে জল অর্পণ করা এবং গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা ইতিবাচক শক্তি বৃদ্ধি করে ।
ত্রিপুষ্কর সময়ে বর্জনীয় কাজ:-----
যেহেতু এই সময়ের প্রভাব তিনগুণ হয়, তাই অশুভ প্রভাব এড়াতে কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত:-----
1. কারো কাছ থেকে ঋণ নেওয়া বা কাউকে ঋণ দেওয়া ।
2. জমি বা সম্পত্তি বিক্রি করা এবং কোনো আইনি নথিতে স্বাক্ষর করা ।
3. বিবাহ বা বাগদানের মতো মাঙ্গলিক কাজ এই অশুভ যোগের সময় না করাই শ্রেয় ।
সতর্কতা:--------
যদি পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যু এই যোগে ঘটে, তবে শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী বিশেষ পঞ্চস্বস্ত্যয়ন বা পুষ্কর শান্তি পূজা করা জরুরি যাতে অশুভ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে ।
ত্রিপুষ্কর যোগে কোনো অশুভ ঘটনা ঘটলে তার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই এই সময়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, লেনদেন বা ঝুঁকি নেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। এই পূজা ও বিধি অবশ্যই পঞ্জিকা অনুসারে অভিজ্ঞ জ্যোতিষীর পরামর্শ নিয়ে করা প্রয়ো