দক্ষিণা
দক্ষিণা:----
বৈদিক নারীরা নিজেদের আত্মাকে যতটা সম্ভব কলুষমুক্ত রাখার চেষ্টা করতেন। আত্মার সাধনা করতেন তাঁরা। অন্তরাত্মা যাতে বিশুদ্ধ থাকে, যাতে সঠিক পথে চলতে পারে তার সাধনা করতেন বৈদিক নারী ঋষিরা।
বেশিরভাগ বৈদিক নারী-ঋষি বা ঋষিকারা তাঁদের বাবাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তেমনই এক নারী ঋষি ছিলেন ঋষি দক্ষিণা।
ঋষি প্রজাপতির কন্যা ছিলেন এই ঋষি দক্ষিণা। মেধাবী, বিদূষী এই ঋষিকা ছোট থেকেই ঋকবেদের চর্চা করতেন। বাবার থেকেই মূলত মন্ত্র-চর্চা শিখেছিলেন তিনি।
একটা বিষয় এই ঋষিকাকে বিব্রত করত। ঋষি প্রজাপতি ছিলেন যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারার ক্ষমতাবান ঋষি। দক্ষিণা দেখতেন বাবা কোন যজ্ঞ সম্পন্ন করার শেষেও খালি হাতে ফিরতেন। কখনও কোন পরিবার থেকে বিশেষ কোনও উপহার বা উপঢৌকন দেওয়া হলে আলাদা কথা নইলে সম্মান-দক্ষিণা বা কোন সাম্মানিক দেওয়ার রীতি ছিল না সেই সময়। এই বিষয়টা ঋষি দক্ষিণাকে বিব্রত করেছিল। প্রশ্ন জেগেছিল তাঁর মনে। তাঁর মনে হয়েছিল এমন পবিত্র বিশেষ কাজ সম্পন্ন করার পর ঋষিদের কোন সম্মান-দক্ষিণা দেওয়া হবে না কেন!
ঋকবেদের যুগে সেই সময় পুজোআচ্চা বা কোন যজ্ঞ সম্পন্ন করার পর দক্ষিণা দেওয়ার রীতি ছিল না। এই সংক্রান্ত কোনো মন্ত্র ছিল না। ঋষি দক্ষিণা তখন এই বিষয়ে মন্ত্র রচনা করেছিলেন।
তাঁর মতে যে কোন পবিত্র, সাধনাসর্বস্ব কাজের পুরস্কার-স্বরূপ কিছু থাকা উচিত। সেই ভাবনা থেকেই ঋকবেদে ঋষিদের দক্ষিণা দেওয়ার মন্ত্র রচনা করেছিলেন ঋষিকা দক্ষিণা।
তার মতে এই সম্মান-দক্ষিণা বা উপহার বা পুরস্কার উৎসাহিত করবে কাজকে। যজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার পর সেই ঋষির প্রশংসাও প্রাপ্য বলে মনে করতেন ঋষি দক্ষিণা। ঋক বেদের ১০৭ তম সূক্তের ঋষি তিনি। ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ১০৭ তম সূক্তের মন্ত্রগুলি রচনা করেছিলেন ঋষি দক্ষিণা। তাঁর রচিত প্রত্যেকটি মন্ত্রই যজ্ঞ সম্পন্ন করার পর ঋষিদের পুরস্কার বা উপহার দেওয়ার কথা বলে।
পুজোর পর পুরোহিত বা ঋষিদের উপহারস্বরূপ দক্ষিণা দেবার প্রথাটি ঋষি-দক্ষিনার মন্ত্র রচনা করার পর থেকেই শুরু হয়েছিল। ঋষি দক্ষিণা মহিলা পুরোহিতদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করার কথা বলে গেছেন।
বৈদিক যুগে নারীরা এমনই সম্মানীয় অবস্থানে ছিলেন যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছিল সমাজের রীতিনীতি। এইসব নারীরা নিঃসন্দেহে সমাজের যেকোনো ক্ষেত্রের দৃষ্টান্ত।
দক্ষিণা শব্দের অর্থ হলো দান, সম্মানী, উপহার, প্রণামী। এটি একটি সংস্কৃত শব্দ। বৌদ্ধ, হিন্দু, শিখ ও জৈন সাহিত্যে দক্ষিণা শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
দক্ষিণা শব্দের অর্থ: মঠ বা মন্দিরে আধ্যাত্মিক আচার-অনুষ্ঠানের পরে প্রদত্ত দান বা সম্মানী, শিক্ষা সমাপণান্তে ছাত্রকর্তৃক উপাধ্যায়কে দেওয়া প্রণামী, পুরোহিতের প্রাপ্য পারিশ্রমিক, গুরুর কাছে আর্থিক নিবেদন, প্রশিক্ষণ বা নির্দেশনার জন্য গুরুর সম্মানী.
বৈদিক যুগথেকেই দক্ষিণা উৎসর্গ করা যজ্ঞ তথা ব্রত কর্মের একটি প্রধান অঙ্গ৷ অর্থাৎ যতক্ষণ আপনি পুরোহিত কে যথাযথ দক্ষিণা প্রদান করেননি, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার পূজো সম্পূর্ণ হয়নি,আপনার পূজো সফল হয়নি। না,আমি বলছি না। স্বয়ং পবিত্র বেদ বলছে,
"তদু তদ্ যজ্ঞস্থ্য কর্ম ন ব্যমুচ্য যদ্ দক্ষিণামাসীৎ।।
[শতপথ ব্রাহ্মণঃ৩|৫|১|১৮]
বৈদিক শাস্ত্রে পুরোহিত ঋত্বিগণকে যথোপযুক্ত দক্ষিণাপ্রদান যজমানের একান্ত 'ধর্ম' বলা হয়েছে।দক্ষিণা মানে বেতন নয় কিন্তু ।
যেকোনো ব্রত-ক্রিয়ার দান উপস্থিত ঐ ব্রাহ্মণ্-পুরোহিত ছাড়া কোনো আত্মীয় তো দূরে থাক, অন্য কোনো ব্রাহ্মণ পর্যন্ত নিতে পারেনা।যদি নেন তবে অভুক্ত সিংহী যেমন প্রানীদের খেয়ে ফেলে ঠিক তেমনই যে ব্যাক্তি ব্রাহ্মণের দান দক্ষিণা নিজে গ্রহণ করবে পাপ থাকেও গ্রাস করবে।
"তস্মান্ নিবৃত্তদক্ষিণং প্রতিগৃহ্নীয়াত।
সিংহী হৈনং ভূত্বা ক্ষিণোতি।।
[শতপথ ব্রাহ্মণঃ৩|৫|১|২৫]
এবিষয়ে বিভিন্ন পুরাণ থেকে বিস্তারিত লিখলে অনেক লিখা যাবে।এখানে শুধুমাত্র ব্রহ্মবৈর্বত পুরাণের প্রকৃতিখন্ডের কিছু নির্দেশনা তুলে ধরছি।সেখানে বলছে,
-"ব্রত সম্পন্ন হলেই দক্ষিণা দিয়ে দিবে, না দিলে প্রতি ক্ষণে ক্ষনে তা বৃদ্ধি হয়। দক্ষিনা সাথে সাথে না দিলে তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি, একদিন পর দিলে হইলে দশ গুণ, তিন দিন অতীত হইলে তাহার শতগুণ, একমাসে লক্ষগুণ ও এক বছর গত হইলে তিনকোটিগুণ বৃদ্ধি হয় এবং যজমানের সেই কৰ্ম্ম নিষ্ফল ও কর্মকর্তা ব্রহ্মহত্যাপাপী হয়। লক্ষ্মী শাপ দিয়ে তার ঘর হতে চলে যান। ঘরে আয় বৃদ্ধি হয়না,রোগ- ব্যাধি হয়, তাহার দেওয়া শ্রাদ্ধতর্পণাদি তারপিতৃগণ গ্রহণ করেন না।