চাণক্য সূত্র - চাণক্য উপদেশ
আশয়া বধ্যতে লোকঃ ॥১॥
অনুবাদ : লোক আশা পাশে বন্ধ থাকে। ১।
মর্মার্থ : সংসারে আশা বিষয় বা প্রবৃত্তি দ্বারা লোক আবদ্ধ হয়। আশা বা বিষয় বাসনা যদি উত্তম বিষয়ে হয়, তার সে মানব আশানুরূপ সাধনা ও কার্য করে শ্রেষ্ঠ হতে পারে। অসাধু বিষয়ে আশা বর্ধিত হলে অধঃপতন হয়। দুরাশা পরিত্যাগ করা উচিত। ১।
নচাশাপরৈঃ শ্ৰীঃ সহ তিষ্ঠতি ॥ ২ ॥
অনুবাদ : যারা আশা পাশে বিশেষভাবে বদ্ধ, তাদের সহিত লক্ষ্মী অবস্থান করেন না। ২।
মর্মার্থ : আশা রঞ্জু দ্বারা আবদ্ধ হয়ে সংসার চক্র নিয়ত যারা ভ্রমণ করতে থাকে, সেইরূপ ধৈর্য, ধৈর্যহীন লোকের সহিত লক্ষ্মী বাস করেন না। দুরাশা পরিহার করে সদাশা বৃদ্ধি করা একান্ত উচিত। বৃথা আশা নিষ্ফল হয়। আশার শান্তিতে ও পরিমিত লাভে শান্তি পাওয়া যায়। ২।
নাস্ত্যাশা পরে ধৈৰ্য্যম্ ॥ ৩॥
অনুবাদ : আশাপরায়ণ লোকের ধৈর্য থাকে না। ৩।।
মর্মার্থ : যারা নিয়ত চিন্তা চক্রে ভ্রমণ করে, তাদের বিষয় ব্যগ্রতা ও লোলুপতাহেতু ধৈর্য নষ্ট হয়ে যায়। তাতে শান্তি এবং সন্তোষ লাভে অবসর পাওয়া যায় না। ৩।
দৈনান্মরণমত্তমম্ ॥৪॥
অনুবাদ : দরিদ্রতা হতে মরণ উত্তম। ৪।
মর্মার্থ : দৈন্য হতে মরণই উত্তম, অতএব দৈন্য পরিহারের জন্য সর্বদা সদুপায় অবলম্বন করা উচিত। ৪।
আশাপরো নিলর্জ্জো ভবতি ॥ ৫॥
অনুবাদ : আশাপরায়ণ ব্যক্তি নির্লজ্জ হয়। ৫।
মর্মার্থ : বিষয়াভিলাষ অতি মাত্রায় বর্ধিত হলে তার সাধুকার্য ও অসাধুকার্য জ্ঞান থাকে না। ক্রমে লজ্জাহীন হয়ে, গহিত আচরণ দ্বারা নিজেকে বিপন্ন করে, অতএব অতি আশা ও দুরাশা পরিহার করা উচিত। ৫।
ন মাত্রা সহ বাসঃ কর্তব্যঃ ॥ ৬ ॥
অনুবাদ : যুবতী মাতার সহিত বাস করা উচিত নয়। ৬।
মর্মার্থ : যুবতী জননী, বিমাতা প্রভৃতি অগম্যাগণের সহিত একাশয্যায় শয়ন–একাসনে উপবেশন, একসঙ্গে অশন, পানাদি তরুণ পুত্রের অবিধেয়। বৃদ্ধা জননী বিমাতা প্রভৃতির সহ পুত্রের একত্র শয়ন, উপবেশন প্রভৃতিতে দোষের সম্ভাবনা নেই। ভোগলোলুপ দুর্জয় ইন্দ্রিয়গণ সময়ে বিদ্বান ব্যক্তিকেও আকর্ষণ করতে সমর্থ। অতএব সাবহিত চিত্ত হয়ে পৃথকভাবে অবস্থান করবে। ৬।
নাত্মা ক্কাপি স্তোতব্য: ॥ ৭
অনুবাদ : নিজ গুণের প্রশংসা স্বয়ং করবে না। ৭।
মর্মার্থ : নিজের প্রশংসা স্বয়ং লোকসমাজে অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়। পরানিষ্টকারী ও স্বার্থানেষীর গুণাবলি সহজে প্রকাশ পায় না। ৭।
ন দিবা স্বপ্নং কুৰ্য্যাৎ ॥ ৮
অনুবাদ : দিবসে শয়ন করবে না। ৮।
মর্মার্থ : দিবানিদ্রা দ্বারা কার্যহানি ও স্বাস্থ্যহানি হয়। আলস্য বৃদ্ধি পায়, বুদ্ধিমান্দ্য ঘটে, কার্যে ফুর্তি থাকে না। অবস্থাবিশেষে ও রোগ বিশেষে দিবানিদ্রা প্রয়োজন। প্রত্যহ দিবান্দ্রিা অহিতকর। ৮
নচাসন্নমপি পশ্যত্যৈশ্বৰ্য্যতিমির চক্ষুশূণোতীষ্টম্ ॥ ৯
অনুবাদ : ঐশ্বর্য মত্তান্ধ ব্যক্তি নিকটের বস্তুও দেখতে পায় না, হিত বাক্যও শুনে না। ৯।
মর্মার্থ : স্বাস্থ্যহীনতা ও মত্ততা প্রভৃতি দোষে লোক যেমন বৃহৎ বস্তুকে ক্ষুদ্ররূপে দেখে, দ্ৰপ ধনমত্ত ব্যক্তি নিকটের বস্তুও দেখতে পায় না, হিত ও প্রিয়বাক্য শুনতে চায় না। চক্ষুকে মত্ততার পটল পড়ে এবং কানে বধিরতা হয়। এটি ধন মত্ততার ফল। বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির তা হয় না। ৯।
শ্ৰীণাং ন তত্ত্বঃ পরংদৈবতম্ ॥ ১০।
অনুবাদ : শ্রীগণের পতি হতে শ্রেষ্ঠ দেবতা নেই। ১০।
মর্মার্থ : নারীগণের পতিই শ্রেষ্ঠ দেবতা, তার সেবা, আরাধনা করবে। পতির প্রতি সেবা প্রভৃতিতে তৎপর থাকলে তাদের পরমেশ্বরদত্ত একমাত্র সতীত্ব সত্যের হানির আশঙ্কা হতে পারে। যারা তা মানতে চায় না, তারা সতীত্ব সত্যের মূল্য বুঝেন না। ১০
তদনুবর্তনভয়-সৌখ্যম্ ॥১১৷
অনুবাদ : পতির অনুসরণ করা ইহকালে ও পরকালে সুখজনক। ১১।
মর্মার্থ : স্ত্রী সকল সময়ে সকল কার্যে পতির অনুসরণ করলে, উভয় লোকই শান্তি ও সুখকর হয়। স্ত্রীধর্মও যথাযথ পরিপালিত হয়। উভয়ের অনৈক্য ঘটলে সমগ্রজীবন ক্ৰেশকর হয়ে থাকে। বিষয় বৈরাগ্য ভিন্ন স্বাতন্ত্রকামী স্ত্রীজীবন অবিশ্বস্ত ও ধর্মবিরুদ্ধ। ১১।
অতিথিমভ্যাগতং পূজয়েদ্ যথাবিধি ॥ ১২
অনুবাদ : যথাবিধি অতিথি ও অভ্যাগতের সৎকার করবে। ১২।
মর্মার্থ : যার আগমনকালের নিশ্চয় নেই, সে অতিথি, যার আসার সময় অবধারিত থাকে সে অভ্যাগত। গৃহস্থ যথাশক্তি এই উভয়ের অভ্যর্থনা, আসন, বারিদান, মধুর, ভাষণাদি দ্বারা তৃপ্তি সাধন করবে। এই কার্য গৃহস্থের সহজে অনুষ্ঠেয় ধর্মম্বরূপ এটি দ্বারা অসময়ে অন্নের আশ্রয়দান ও হিতসাধন করা হয়। ১২।
নিংসম্বিভাগী স্যাং ॥ ১৩ ॥
অনুবাদ : নিত্যই বিভাজনপরায়ণ হয়ে কার্য করবে। ১৩।
মর্মার্থ : স্বীয় অর্থ প্রত্যহ অতিথি দেব, পিতৃলোক, দীন, অন্ধ, পঙ্গু, অনাথ দিকে প্রদান করে তৎপরতার ব্যবহার করবে। ইন্দ্রিয়, উদয় সেবার নিমিত্ত ধন নয়। যে ধন দ্বারা স্বল্পর কল্যাণ সাধিত হয়, সেই অর্থই সার্থক। এরূপ ধনের সম্যক, বিভাগে সমাজের প্রভূত হিতসাধন হতে পারে। ১৩।
নাস্তি হব্যস্য ব্যাঘাতঃ ॥১৪ ॥
অনুবাদ : হব্য দ্রব্যের কোনো ব্যাঘাত নেই। ১৪।
মর্মার্থ : দেবাদির উদ্দেশ্য বা অন্নরূপে আনীত হয়, তা হব্য। পিত্রাদির উদ্দেশ্যে দেয় বস্তুকব্য। তাদৃশ উপাদেয় বস্তুর কোনো ব্যাঘাত হয় না, যেমন সত্য; কোনো না কোনো দেবতারাই তা রক্ষা করে থাকেন। দৈবশক্তিযুক্ত দ্রব্যের তাদৃশগতি হয়ে থাকে। ১৪।
মৃগতৃষ্ণা জলবদ্ভাতি ॥ ১৫।
অনুবাদ : মৃগতৃষ্ণা দেখতে জলের ন্যায় প্রকাশ পায়। ১৫।
মর্মার্থ : মরুভূমিতে প্রখর সৌরালোক পতিত হলে, তার উপরিভাগে জলতরঙ্গের ন্যায় দেখায়। মৃগগণ জলপিপাসু হয়ে জলভ্রমে তথায় ধাবিত হয়, এই নিমিত্ত একে মৃগতৃষ্ণা বলে। এটি মৃগের ভ্রম ও নাশের হেতুভুত। সেরূপ লোভপরায়ণ মানুষের পক্ষে বিষয় শ্রম ও অনিষ্টকারক। প্রবঞ্চকের হাতে পতিত হলেও তাই হয়। ১৫।
শত্ৰু ৰ্মিত্রবৎ প্রতিভাতি ॥ ১৬৷
অনুবাদ : কখনো শত্ৰুমিত্রের ন্যায় প্রকাশ পায়। ১৬।
মর্মার্থ : চতুরতা ও কপটতার আশ্রয় করে কার্য সাধনের উদ্দেশ্যে শত্রু কখনো বন্ধুর ন্যায় আচরণ করে। লোভ প্রদর্শন এবং স্বার্থসিদ্ধির পথ দেখিয়ে তাদৃশ ভাব প্রকাশ করে। বুদ্ধিমান সেরূপ ভাব লক্ষ করতে সমর্থ হলে, শত্রুর ফাঁদে পড়ে না। অতি লোভে শত্রুর কখন প্রমাদগ্রস্ত হয়ে থাকে। ১৬।
উপালম্ভোনাস্ত্য প্রণয়েযু ॥ ১৭ ॥
অনুবাদ : প্রণয়হীন লোকের নিন্দা দ্বারা কোনো হানি হয় না। ১৭।
মর্মার্থ : সুহৃদ ও প্রিয়জনের নিন্দা করা অনুচিত। যাদের সঙ্গে প্রণয় নেই, তাদের নিন্দায় কোনো ক্ষতি নেই। রাগের বিষয়ে কোনো নিন্দা হলে তা উপেক্ষা করা উচিত। ক্রোধপূর্বক কার্য সাধন করতে হলে তাতেও নিন্দা ভয়ে ভীত হবে না। ১৭।
দুর্মে ধসাংমহচ্ছাং বুদ্ধিং মোহয়তি ॥১৮
অনুবাদ : মেধাহীনের কঠিন শাস্ত্র পাঠে বুদ্ধির ভ্রম হয়। ১৮।
মর্মার্থ : যার যেরূপ বুদ্ধি, তার নানা বিষয় পাঠে সেরূপ জ্ঞান হয়। মন্দ বুদ্ধির কঠিন শাস্ত্র পাঠে বুদ্ধিবিমোহিত হয়। মলিন বুদ্ধির ন্যায় ও অঙ্কশাস্ত্র পাঠে সেরূপ অবস্থা দেখা যায়। মেধাহীনের জটিল এবং বিশাল শাস্ত্র অধ্যয়নে জ্ঞান বৃদ্ধি পায় না। ১৮।
যত্র সুখেন বর্তনে তদেবস্থানম্ ॥ ১৯ ॥
অনুবাদ : যে স্থান সুখে বাসের যোগ্য, সে স্থানে বাস করবে। ১৯।
মর্মার্থ : যে স্থানে শ্রোত্রিয় (বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ), নদী, বৈদ্য, লোকযাত্রা, ভয়শীলতা গর্হিত কার্যে লজ্জা দাক্ষিণ্য, ধর্মশীলতা, বাণিজ্য, কৃষি, গো-পালন, জীবিকা, সুবিচার, বিদ্যাচর্চা, শিল্প প্রভৃতি বিদ্যমান সেরূপ স্থানই বাসের সম্যক উপযুক্ত। ঈদৃশ স্থানেই লোকের প্রতিভার বিকাশ হয়। ১৯।
সৎসঙ্গঃ স্বর্গবাসঃ ॥ ২০ অনুবাদ : সাধু সঙ্গ স্বর্গবাসতুল্য। ২০। মর্মার্থ : সৎসঙ্গ ও অসৎসঙ্গ দ্বারা উৎকর্ষ ও অপকর্ষ ঘটে থাকে। যেমন সূর্ব টঙ্কণ (সোহাগ) অগ্নিসংযোগে নির্মল হয়। তামা ও অগ্নিযোগে মলিন এবং দৃঢ় বিবর্ণ হয়। মানুষেরও সসঙ্গে উন্নতি, অসাধু সঙ্গ পতন ঘটে। ২০।
আৰ্য্যঃ স্বমিব পরং মন্যতে ॥ ২১
অনুবাদ : আর্য ব্যক্তি নিজের ন্যায় পরকেও মনে করে। ২১।
মর্মার্থ : শ্রেষ্ঠুজ্ঞান ও জ্ঞানবৃদ্ধ ব্যক্তি আর্য নামে খ্যাত। তাদৃশ ব্যক্তি নিজের সুখ ও দুঃখের ন্যায় অপরের সুখ ও দুঃখ মনে করে থাকে। অর্থাৎ পরের সুখে সুখী এবং পরের দুঃখে দুঃখি হয়। এইরূপ সুখে প্রসন্ন হওয়া, দুঃখে সাহায্য ও ত্রাণ করা আর্যের লক্ষণ। ২১।
প্রায়েশ রূপানূবৃৰ্ত্তিনোগুণাঃ ॥ ২২
অনুবাদ : যার যাদৃশরূপ তদনুসারে প্রায় গুণও হয়ে থাকে। ২২।
মর্মার্থ : যেখানে সৌম্যভাব, সেখানে সৌম্যগুণ থাকে, ইহা প্রসিদ্ধ উক্তি। রূপ অপেক্ষা গুণই মহার্ঘ। সুতরাং রূপ হতে গুণের প্রয়োজন অধিক। ২২।
বিশ্বাস ঘাতিনো নিষ্কৃতির্নবিদ্যতো ॥ ২৩
অনুবাদ : যে বিশ্বাসঘাতক তার নিষ্কৃতি নেই। ২৩।
মর্মার্থ : জগতে সকল ব্যবহারিক কার্য বিশ্বাসকে আশ্রয় করে পরিচালিত তথা সম্পাদিত হয়, যে বিশ্বাস বিনষ্ট করে অনিষ্টাচরণ করে, তার ইহলোকে কল্যাণ নষ্ট হয় ও পরলোক পাপ হতে অব্যাহতি নেই। ২৩।
দৈবায়ত্তং ন শোচয়েৎ ॥ ২৪
অনুবাদ : দৈবাধীন বিষয়ে শশাচনা করবে না। ২৪।
মর্মার্থ : যা মানুষের শক্তির অতীতরূপে প্রকাশ পায়, তা দৈবাধীন, ভূকম্প, উল্কাপাত ঝঞ্ঝাবায়ু, বারিপ্লাবন, মহামারি প্রভৃতি লোক বুদ্ধির অতীত। এই সকল বিষয়ে প্রতিকার করতে সমর্থ হলে উত্তম; না হলেও বৃথা শোচনা এবং অনুতাপ করবে না। ২৪।
আশ্রিত-দুঃখমাত্মন ইব মন্যতে সাধুঃ ॥ ২৫
অনুবাদ : সাধুগণ অনুগত লোকের দুঃখ নিজের দুঃখের ন্যায় মনে করেন। ২৫।
মর্মার্থ : সাধু, মহাজন, মহোদার চরিত, বিদ্বান, ব্যক্তি নিজের ও পরের দুঃখে সমজ্ঞানবশতঃ পরের দুঃখকাতর হয়ে থাকে। যাদের এরূপ সমদর্শিতা আছে, তারাই দেশ ও জনহিতকরণে সমর্থ হন। সৎসঙ্গ, সুশিক্ষা, সততা ও ধর্মাচরণ দ্বারা সম্ভাবে হৃদয় গঠিত হয়। অন্তরে বিদ্বেষ বিষ জন্মায় না। ফলে তিনি হন বিশ্ববন্ধু। ২৫।
হৃদগতমাচ্ছাদ্যান্যদ্বদত্যনাৰ্য্যঃ ॥ ২৬
অনুবাদ : অনার্য ব্যক্তি নিজের হৃদয়ের ভাব গোপন করে অন্যরূপে বলে। ২৬।
মর্মার্থ : শঠ, কপট, শবর প্রভৃতি মানুষেরা মনোগত ভাব গোপন করে নিজের মুখে অন্যরূপ বলে। তাদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যই হলো অপরকে প্রতারণা করা। এরূপ আচরণে সমাজে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। আর্যগণ তার বিপরীত করে থাকে। ২৬।
ধীহীনঃ পিশাচাঁদনন্যঃ ॥ ২৭
অনুবাদ : ধীশক্তিহীন ব্যক্তি পিশাচ হতে ভিন্ন নয়। ২৭।
মর্মার্থ : যার অতি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সে তার দ্বারা ন্যায়, অন্যায়, কর্তব্যাকর্তব্য স্থির করতে সমর্থ। বুদ্ধিহীন ব্যক্তি বিবেকশূন্য হওয়াতে পিশাচের ন্যায় স্বেচ্ছাচারী হয় ও ক্রমে হীনতায় আচ্ছন্ন হয়। ২৭।
অসহায়োন পথিগচ্ছেৎ ॥ ২৮
অনুবাদ : সহায়শূন্য পথে গমন করবে না। ২৮।
মর্মার্থ : যে স্থলে ভয়ের কারণ বিদ্যমান, সে স্থলে ভয় নিবৃত্তির উপায় অবলম্বনপূর্বক কার্য করতে হয়। যেমন সুদূরপথে গভীর রাত্রিতে একাকী গমন করা উচিত নয়। পথে দস্যু তস্কর, হিংস্ৰজন্তু ও রোগাদির আশঙ্কা থাকে, অতএব অপর বিশ্বস্ত লোকসহ যাওয়া উচিত। বর্ষা গ্রীষ্মকালে ছত্রধারণ করবে, রাত্রিতে অরণ্যে দণ্ড ও অস্ত্রধারণপূর্ব যাবে। শরীর রক্ষাকারী সকল সময়ে চর্মপাদুকা ধারণাপূর্বক গমন করবে। ২৮।
নপুত্রঃস্তোতব্যঃ ॥ ২৯৷
অনুবাদ : পুত্রের স্তব করা উচিত নয়, অথবা করবে না। ২৯।
মর্মার্থ : সকল সময়ে পুত্রের প্রশংসা করা উচিত নয়। পুত্রকে স্নেহ, পালন, সুশিক্ষা প্রদান করবে। যাতে সদ্বুদ্ধির বিকাশ হয় ও উন্নত হয়, সে বিষয়ে নীতি উপদেশ হবে। পুত্র সুধী হলে তার জীবন উন্নত ও আপদশূন্য হয়। কিন্তু নিরন্তর তার প্রশংসা করলে তার অহংকার জন্মায়, তার ফলে তার অবনতিই হয়। ২৯।
স্বামী স্তোতব্যঃ সর্বানুজীবিভিঃ। ॥ ৩০ ॥
অনুবাদ : ভৃত্য ও আশ্রিতগণ প্রভুর স্তুতি করবে। ৩০।
মর্মার্থ : আশ্রিত, অনুজীবী, সেবক, উপকৃত ব্যক্তিগত স্বামীর প্রশংসা ও স্তুত করবে, অন্যথায় কৃতঘ্নতা প্রকাশ পায়। সমাজে প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ সুখজনক হয় না। কেহই কারও উপকার স্বীকার করতে প্রস্তুত না হলে, কার্যক্ষেত্র বাধা-সঙ্কুল হয়। উপরন্তু প্রভুর স্তুতি দ্বারাই আশ্রিত বা অনুজীবীদের প্রভুর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। আর সেই দৃষ্টে প্রভুও ভৃত্যের বা অনুজীবীদের প্রতি স্নেহশীল ও সহৃদয় হন। ৩০।
ধর্মকৃত্যেম্বপি স্বামিনমেব ঘোষয়েৎ ॥৩১ ॥
অনুবাদ : সকল কার্যেই গুরুর অনুমতি গ্রহণ করবে ৩১।
মমার্থ : সকল ধর্মকার্যে গুরুজন,গুরুর অনুমতি গ্রহণ করা বিধেয়। তাতে আরদ্ধ কার্য বাধাবিঘ্ন শূন্য হয়ে সম্পন্ন হতে পারে। ৩১।
গুরুরসজ্ঞাং নাতিলঙ্ঘয়েৎ ॥ ৩২ ॥
অনুবাদ : গুরুর উপদেশ বিশেষভাবে লঙ্ঘন করবে না। ৩২।
মর্মার্থ : গুরুর আজ্ঞা, আদেশ প্রভৃতি লঙ্ঘন করলে স্বীয় বিপদ ও অশান্তির আবির্ভাব হয়। ৩২।
স্বাম্যনুগ্রহেধৰ্ম্ম কৃত্যং আশ্রিতনাম্ ॥ ৩৩ ॥
অনুবাদ : গুরুর অনুগ্রহই আশ্রিতগণের ধর্মকার্য। ৩৩।
মর্মার্থ : অনুগতগণ গুরুকৃপা লাভ করতে সতত চেষ্টিত হবে। ৩৩।
যথাজ্ঞপ্তং যথা কুৰ্য্যাৎ ॥ ৩৪ ॥
অনুবাদ : যেরূপ আদেশ করবে, অনুগতগণ সেরুপ আচরণ করবে। ৩৪।
মমার্থ : আদেশ অনুসারে কার্য করলে কার্যে কোনো বিঘ্ন থাকে না। বিধান লঙ্ঘন করে স্বেচ্ছামূলক কার্য করা উচিত নয়। সেরুপ কার্যে যথেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পেয়ে সমাজ উদ্ধৃঙ্খল হয়ে বিপদসমূহে পতিত হয়। সকল মতের উপর আদেশ প্রবল। ৩৪।
সবিশেষং বা কুৰ্য্যাৎ ॥ ৩৫ ॥
অনুবাদ : গুরুর আদেশে সবিশেষ কার্য করবে। ৩৫।
মর্মার্থ : গুরুর আদেশ অনুসারে ব্যবহারিক বা নৈতিক কার্য করবে। কুলাচার, দেশাচার প্রভৃতি বিশেষ বিভিন্ন দেশের সমাজের বিবিধকর্ম সকল করবে না। ৩৫।
স্বামিনোভিরুঃ ক্কোপযুজ্যতে ॥৩৬ ॥
অনুবাদ : গুরুর নিকট ভীত লোকের কোনো কার্যে উপযোগিতা নেই। ৩৬।
মর্মার্থ : ভীরুতা, কার্যে অযোগ্যতার নামান্তর, আলস্য প্রভৃতিও কার্যহানিকারক। ভীত বুদ্ধিহীন, সাহসহীন, অধীর- এরা গুরুরকার্যে অযোগ্য। বলবান , প্রত্যুৎপন্নমতি সুধি, উদ্যম ও অধ্যবসায়যুক্ত ব্যক্তি বহুঁকার্যের যোগ্য। বিশেষ করে ভয়শূন্যতা গুরুরকার্য সাধনের পক্ষে উল্লেখ্য যোগ্যতা। ৩৬।
নাস্ত্যনাৰ্য্যস্য কৃপা ॥৩৭ ॥
অনুবাদ : অনার্য জনের কৃপা থাকে না। ৩৭।
মর্মার্থ : অনার্যদের মধ্যে যেহেতু কোনো সদগুণ থাকে না, সেহেতু দয়া, দাক্ষিণ্য, কৃপাও থাকে না। ৩৭।
নাস্তি বৃদ্ধিমতাং শত্রু ॥ ৩৮ ॥
অনুবাদ : বুদ্ধিমান লোকের শত্রু নেই। ৩৮।
মর্মার্থ : মতিমান ব্যক্তি কৌশল, মধুরভাষণ এবং তাদৃশ ব্যবহার দ্বারা শত্রুকেও মিত্র করে তোলে। বৃথা কারও অনিষ্ট সাধন করে না। উপকার করবার সুযোগ পেলে তা দ্বারা সকলকে বশীভূত করে। বিপরীত পক্ষে যারা বুদ্ধিমান, তারা পরের গুণগ্রাহিতার অজাতশত্রু হিসেবে পরিচিত হবেন। ৩৮।
শত্ৰুংন নিন্দে সভায়াম্ ॥৩৯ ॥
অনুবাদ : সভাস্থলে শত্ৰু নিন্দা করবে না। ৩৯।
মর্মার্থ : বহু লোকের নিকট সভাস্থলে শত্রুর নিন্দা করলে, সে বিশেষভাবে অপমানিত ও ক্রদ্ধ হয়ে গুরুতর অনিষ্ট সাধনে উদ্যত হতে পারে। তাকে বুদ্ধি বলে পরাজিত করবে। ৩৯।
শক্তৌ ক্ষমা শ্লাঘনীয়া ॥ ৪১ ॥
অনুবাদ : শক্তিমান পুরুষের ক্ষমাশক্তি প্রশংসাহ। ৪১।
মর্মার্থ : দুর্বলের ক্ষমাশক্তি দুর্বলতার পরিচায়ক। অপমান, রাগ, ক্ষতি সহনের নাম ক্ষমা। শক্তিহীনকে ক্ষমা ও স্নেহ করবে। অবস্থা বিশেষে ক্ষমা বিশেষ উপকারক। ত্যাগশীল ও মুনিগণের ক্ষমাই বল। ৪১।
ক্ষমাবানেব সৰ্ব্বৎ সাধয়তি ॥ ৪২ ॥
অনুবাদ : ক্ষমাশীল ব্যক্তি সকল কার্য সাধন করতে সমর্থ। ৪২।
মর্মার্থ : ক্ষমা গুণে সকল লোক বশীভূত হয়, ক্ষমাশক্তি থাকলে বহু বিবাদ হতে রক্ষা পাওয়া যায়। ক্ষমাযুক্ত পুরুষগণ আক্লেশে নানাকার্য সাধনে যোগ্য। অপর কোনো ব্যক্তি অপকার করলে, তার অপকার সাধনে পরাজুখ করে থাকে ক্ষমা। তপস্বী ও মহাপুরুষের ক্ষমা প্রধান গুণ। ক্রোধপরায়ণ ব্যক্তির পক্ষে ক্ষমা বিশেষ হিতকর। ৪২।
আপব প্রতীকারার্থং ধনমিয্যতে ॥ ৪৩ ॥
অনুবাদ : আপদকাল উপস্থিত হলে তার প্রতিকারের নিমিত্ত ধনের প্রয়োজন। ৪৩।
মর্মার্থ : বিপদ সময়ে তার প্রতিকারের জন্য ধন নিতান্ত আবশ্যক। ধনের দ্বারা নানা উপায়ে বিপদের প্রতিবিধান করা যায়। নির্ধন ব্যক্তি বিপদ দ্বারা পরাভূত হয়। সংসারে অতি কঠোর কার্য বা দুঃসাধননীয় কার্যধনের দ্বারা সাধিত হয়। সৎপথগামী ধন হতে ধর্ম, যশ, শ্রীভগবক্তৃপাও লাভ হতে পারে। সৎপথগামী ধনবান ধন দ্বারা বিপদকে ব্যাহত করতে সমর্থ।৪৩।
সাহসবং প্রিয়ং কর্তব্য ॥ ৪৪
অনুবাদ : সাহসসম্পন্ন ব্যক্তিগণের প্রিয় কার্যের অনুষ্ঠান একান্ত কর্তব্য ॥ ৪৪
মর্মার্থ : যারা সাহসসম্পন্ন, তারা প্রিয় ও হিতকর কার্য করবে। তাদের শক্তিই কার্য সাধনে যোগ্যতার পরিচালক অথবা যারা সাহস বলে অনেক অর্থাৎ দুঃসাধ্য কার্য সাধনে সমর্থ, তাদের প্রতি প্রীতি সূচক ব্যবহার করবে, তদ্দ্বারা নানা কার্যে সাফল্য লাভ হতে পারে। সাহসকে সম্পদ লাভেরও সাধন বলা হয়। ৪৪।
শ্বঃ কাৰ্য্যমদ্য কুর্বীত ॥ ৪৫ ॥
অনুবাদ : আগামী দিবসে যা কর্তব্য, তা অদ্য করবে। ৪৫।
মর্মার্থ : কর্তব্য কার্য অশেষ–এই হেতু অদ্যকার কার্য পরদিনে করবো বলে আলস্যবশত রেখে দেবে না। তাতে পরদিনের কার্যের ব্যাঘাত হবে। কিন্তু পর দিবসীয় কার্য অদ্য সম্পাদন করতে পারলে, অধিক কর্ম সম্পাদন করতে সমর্থ হবে। যেরূপ বহু কার্যে সাফল্য লাভও অবশ্যম্ভাবী। ৪৫।
আপরাহ্নিকং পূর্বাহ্ন এবকৰ্তব্যম্ ॥ ৪৬ ॥
অনুবাদ : দিবসের শেষভাগে কর্তব্যকার্য পূর্বভাগে করবে। ৪৬।
মর্মার্থ : দিনকে তিন ভাগে বিভক্ত করলে পূর্বাহ্ন, মধ্যহ্ন এবং অপরাহ্ন হয়। যে অপরহ্নে কর্তব্য, সম্ভব হলে তা পূর্বাহ্নে করা উচিত, তাতে বহুঁকার্য সাধন এবং শীঘ্রকার্য ফলভোগী হতে পারা যায়। কার্য মধ্যে বিঘ্ন ও কার্যান্তর উপস্থিত হয়ে অসম্পন্ন কার্যের নিমিত্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় না। এই সূত্র পূর্বোক্ত সূত্রের ব্যাখ্যারূপে ব্যক্ত হয়েছে। ৪৬।
ব্যবহারানুলোম্যেধর্মঃ ॥ ৪৭ ॥
অনুবাদ: ধর্ম ব্যবহার অনুসী হবে। ৪৭।
মর্মার্থ : যার যেরূপ ব্যবহার, তার ধর্মও সেরূপ, সাধুজনের সঙ্গে সত্যমূলক, শঠ, দুর্জনের সঙ্গে দুর্জনমূলক। অথবা পূর্বগণ যেরূপ ধর্মাচরণ করেছেন, পরবর্তীগণও তদনুরূপ আচরণ করবে, ধর্মশাস্ত্র যেরূপ ধর্মাচরণ করবে স্বেচ্ছানুসারে নয়। ৪৭।
সর্বজ্ঞতা লোকজ্ঞতা ॥ ৪৮ ॥
অনুবাদ : যার সাংসারিক সকল বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিদ্যমান, সে লোকজ্ঞ । যার পরমেশ্বর বিষয়ে নিত্য জ্ঞানই সর্বজ্ঞতা।। ৪৮।
মর্মার্থ : সকল বিষয়ে জ্ঞাতৃতাই লোকজ্ঞতা, যার সাংসারিক সকল বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিদ্যমান, সে লোকজ্ঞ। পরমেশ্বর সর্বজ্ঞ তিনি ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্য, শৈল এবং সর্ষপকণা এইরুপ নিত্য প্রত্যক্ষ করেন। তার জ্ঞান নিত্য। মানুষের জ্ঞান ঈশ্বরাগত হলেও ভ্ৰম, প্রমাদ, প্রতারণা, ইন্দ্রিয়জ দোষ থাকলে সেই জ্ঞান অসম্পূর্ণ । ৪৮।
শাস্ত্ৰজ্ঞোইপ্যলোকজ্ঞোমূর্খেষনন্য: ॥ ৪৯ ॥
অনুবাদ : শাস্ত্রবিদ ব্যক্তি লৌকিক বিষয়ে অনভিজ্ঞ হলে সে মূর্খতুল্য। ৪৯।
মর্মার্থ : শাস্ত্রীর বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে যদি লৌকিক বিষয়ে অনভিজ্ঞ হয়, তবে সে ব্যক্তি মূর্খতুল্য বলে জানবে। লৌকিক বিষয়জ্ঞতা সর্বদা প্রয়োজন, শাস্ত্রীর কার্যে মূর্খ যেরূপ অযোগ্য, লৌকিক বিষয়ে অনভিজ্ঞ, কেবল শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিও বৈষয়িককার্যে তদ্রুপ অযোগ্য। শাস্ত্রীয় ও সাংসারিক বিষয়ে অভিজ্ঞই প্রাজ্ঞ নামে খ্যাত। ৪৯।
শাস্ত্রপ্রয়োজনং তত্তদর্শনম্ ॥ ৫০
অনুবাদ : তত্ত্বদর্শনে শাস্ত্রের বিশেষ প্রয়োজন। ৫০।
মর্মার্থ : তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে হলে শাস্ত্রপাঠের প্রয়োজন। শাস্ত্র বহু বিষয়ে সন্দেহের উচ্ছেদক। শাস্ত্রজ্ঞান পরোজ্ঞ বিষয়ে (অতীন্দ্রিয় পদার্থজ্ঞানে) দর্পণ তুল্য। সকলের চক্ষু স্থানীয়, যার শাস্ত্র জ্ঞান নেই, সে অন্ধ। অন্ধ দৃষ্টিশক্তির অভাবে দেখতে পায় না। শাস্ত্রজ্ঞানহীন ব্যক্তি সেরূপ পদার্থ তত্ত্বজ্ঞানে অন্ধ হয়ে থাকেন। ৫০।
তত্ত্বজ্ঞানং কাৰ্য্যমেব প্রকাশয়তি ॥৫১ ॥
অনুবাদ : বস্তুতত্ত্বজ্ঞান কার্যই প্রকাশ পায়। ৫১।
মর্মার্থ : বস্তুতত্ত্বজ্ঞান দ্বারা সকল বিষয় সুষ্ঠুরুপে বৃদ্ধি পথে ব্যক্ত হয়, শা পাঠে তত্ত্বজ্ঞান জন্মে, তাতে পদার্থ অবভাষিত হয়। ৫১।
অপক্ষপাতেন ব্যবহারঃ কর্তব্যাঃ ॥৫২ ॥
অনুবাদ : পক্ষপাতশূন্য হয়ে বিচার করবে।৫২।
মর্মার্থ : পক্ষপাতমূলক ব্যবহার করলে স্বীয় ও অন্যের প্রচুর ক্ষতির সম্ভাবনা, বিচারকালে এবং সাক্ষ্যদান সময়ে কখনো পক্ষপাত করা উচিত নয়। সেরূপ পক্ষপাত করলে সত্যহানি উপস্থিত হয়, সমাজ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। ব্যবহারে সমদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়ায় প্রাজ্ঞের লক্ষণ। ৫২।
ধৰ্ম্মাদপি ব্যবহারোগরীয়ান্ ॥৫৩ ॥
অনুবাদ : ধর্ম হতেও ধর্ম অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা তার প্রমাণস্বরূপ বাস্তবিক জীবনের কর্ম চরিত্ররূপী ব্যবহারই শ্রেষ্ঠ। ৫৩।
মর্মার্থ : ধর্ম ও তার তত্ত্বজ্ঞান সকল সময়ে অন্তরে বিদ্যমান থাকে, কিন্তু ধর্ম অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা তার প্রমাণস্বরূপ বাস্তবিক জীবনের কর্ম চরিত্ররূপী ব্যবহারে অভিজ্ঞতা সাধারণের অবশ্যই প্রয়োজন হয়। অতএব ব্যবহারের প্রয়োজন অধিক হেতু তার শ্রেষ্ঠ কীর্তিত হয়েছে। ৫৩।
পরমাত্মাহি ব্যবহারস্য সাক্ষী ॥ ৫৪ ॥
অনুবাদ : পরমাত্মা সকল ধর্ম অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা তার প্রমাণস্বরূপ বাস্তবিক জীবনের কর্ম চরিত্ররূপী ব্যবহারের সাক্ষী। ৫৪।
মর্মার্থ : মানব স্বীয় যেকোনো কার্য করবে, সে সকল কার্যের সাক্ষী পরমাত্মা । ইচ্ছা, প্রবৃত্তি, সঙ্কল্প, বিকল্প প্রভৃতি মনেই হয়ে থাকে, তৎপরে লোক কার্যে প্রবৃত্ত হয় আর সেই বাস্তবিক জীবনের কর্ম চরিত্রের বা কর্মের সাক্ষী সকলের অন্তরে অবস্থিত পরমাত্মা। বৌদ্ধদর্শন মতে, মন আলয় বিজ্ঞানস্থানীয় অহমাস্পদ। ৫৪।
সৰ্বসাক্ষী হ্যাত্মা ॥৫৫ ॥
অনুবাদ : পরমাত্মাই সকল কর্মের সাক্ষী। ৫৫॥
মর্মার্থ : সকল কার্যের সাক্ষী পরমাত্মা হয়ে থাকে। আত্মার অগোচর কার্য দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষ ভালো-মন্দ যাই করুক না কেন, সে সমুদয় মনের ব্যাপারপূর্বক হয়ে থাকে। ৫৫॥
ন চকুট সাক্ষী স্যাং ॥ ৫৬ ॥
অনুবাদ : কখনো কূটসাক্ষী হবে না। ৫৬।
মর্মার্থ : সাক্ষাৎ (প্রত্যক্ষ) বিবাদ দ্রষ্টা সাক্ষী হয়ে থাকে। যে সময় যে বিষয় যেরুপ প্রত্যক্ষ করবে, সাক্ষ্যদানকালে যে বিষয় সেরূপ বলবে। এর অন্যথা বললে, সে কুট সাক্ষী নামে অভিহিত হবে। কুট হলো–শঠতা, কপটতা বা বিষয় বঞ্চনা। অতএব কুট সাক্ষীর দ্বারা নিজ ও পরে অনিষ্ট সাধিত হয়। শেষে নিজেও শঠ, বঞ্চক নামে চিহ্নিত হয়। ৫৬।
কূট সাক্ষিণ্যে নরকে পতন্তি ॥ ৫৭ ॥
অনুবাদ : কুট সাক্ষ্যদাতার নরকে পতন হয়। ৫৭।
মর্মার্থ : যারা প্রকৃত বিষয় দেখেশুনে এবং পরিজ্ঞাত হয়ে অন্য প্রকার সাক্ষ্যদান করে, তাদের ঐহিক অপযশ ও পারত্রিক নরকে পতন হয়। তা উৎকৃষ্ট হলে ঐহিক বিশেষ ক্লেশ ভোগ অনিবার্য। তাতে সমাজে দুর্নীতিও বৃদ্ধি পায়। ৫৭।
ন কশ্চিন্নাশয়তি সুমুন্ধরতি বা ॥৫৮ ॥
অনুবাদ : কুট সাক্ষ্যদাতা কাকেও উদ্ধার করে না। ৫৮।
মর্মার্থ : সামান্য হিতের আশায় যারা কুট সাক্ষ্য প্রদান করে, তাদের সে সাক্ষ্য-দ্বারা বিশেষভাবে কেউ বিপদ, হতে উদ্ধার পায় না এবং কোনো শত্রুর সংহারও হয় না। কেবল ঐহিক দুর্নীতি, পারত্রিক পাপের প্রসার বৃদ্ধি করা হয়। সমাজ ও স্বীয় কল্যাণেচ্ছু ব্যক্তির তাদৃশ কার্য হতে বিরত হওয়া সমুচিত। ৫৮।
প্রচ্ছন্ন-পাপানাং সাক্ষিণো মহাভূতানি ॥৫৯ ॥
অনুবাদ : গুপ্ত পাপের সাক্ষীরা হলো শিক্ষিত -মহাভূত। ৫৯।
মর্মার্থ : মানুষ প্রকাশ্যে যে যে পাপের অনুষ্ঠান করে, সমাজে তার সাক্ষী থাকে। গোপনে অনুষ্ঠিত পাপের সাক্ষী প্রথমত মানুষের মন, দ্বিতীয় ক্ষিতি, জল, বায়ু, তেজ, আকাশ এই পঞ্চমহাভূত। এরা অন্তরে ও বাইরে অবস্থিত থেকে সাক্ষী হয়। ধর্মশাস্ত্রের মতে, সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, ভূমি, জল, মন, যম, দিন, রাত্রি উভয় সন্ধ্যাকাল–এরাও লোককৃত কার্যের সাক্ষী। ৫৯
আত্মনঃ পাপমাত্মৈব প্রকাশয়তি ॥ ৬০ ॥
অনুবাদ : স্বীয়কৃত পাপ পরমাত্মা প্রকাশ করে। ৬০।
মর্মার্থ : মানুষ স্বীয় অনুষ্ঠিত পাপের পরিণামে নানা দুঃখ, সৈন্য অনুভব করে। আক্ষেপ ও অনুতাপাদি দ্বারা এগুলো স্বয়ং প্রকাশ করে থাকে। অথবা মনের অগোচরে পাপ হয় না বলে, বিশেষ ক্লেশ রোগ অনুভবহেতু মন দ্বারাই পাপ প্রকাশিত হয়। মানুষের মনই বন্ধন ও মুক্তির হেতু এটি যোগ বা শিষ্টে উক্ত হয়েছে। ৬০।
ব্যহারেহন্তৰ্গতাকারং সূচয়তি। ৬১ ॥
অনুবাদ : কর্ম চরিত্ররূপী ব্যবহার সময়ে অন্তর্গত বিষয়ের স্বরূপ সূচিত হয়। ৬১।
মমার্থ : যে যেরূপ ব্যবহার করুক না কেন, সে সময়ে তার আকার অন্তঃস্থিত বিষয়কে পরিস্ফুট করে থাকে। মনের ভাব গোপন করে ব্যবহারে প্রবৃত্ত হলে বাক্য দ্বারা অস্তরের ভাব অনুমতি বা ব্যক্ত হয়। বাক নিষ্পত্তিকালে অপর ইন্দ্রিয়বৃত্তিও তার অভিমুখী হয়ে থাকে। ৬১।
আকার-সম্বরণন্দেবানমাশক্যম্ ॥ ৬২
অনুবাদ : আকার গোপন করতে দেবগণও সমর্থ হয় না। ৬২।
মর্মার্থ : কার্যের উদ্যোগ, বাক্য বিন্যাসের কৌশল দ্বারা, আকার গোপন করলেও তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। আকার গুপ্তিতে দেবগণও অসমর্থ, বুদ্ধিমানের নিকট আকার গোপন করলে, মুখরাগ দ্বারা বাকবিন্যাসকালে ব্যক্ত হয়ে থাকে। মনোগত ভাবও তখন অনুমিত হয়। কবি বলেছেন, আকারতুল্য প্রজ্ঞা, প্রজ্ঞা সদৃশ আগম কার্যোদ্যোগে গতি, আগমতুল্য আরম্ভ, আরম্ভ সমান অভ্যুদয়। ৬২।
সুদর্শনা হি রাজানঃ প্রজা রঞ্জয়ন্তি ॥ ৬৩ ॥
অনুবাদ : সৌম্যদর্শন নরপতিগণ প্রজারঞ্জন করেন। ৬৩।
মর্মার্থ : প্রিয় দর্শন, দয়া, শৌর্য, গৌরব, সুনীতিপূর্ণ, হৃদয়সম্পন্ন নৃপতিগণ প্রজারজনে সমর্থ হন। প্রজা, রাজ্যশাসন নীতি নিয়ম পালন করবেন, রাজানুগতও প্রতিপালিত নৃপাদেশের দ্বারা প্রজা সুখী। রাজ রোষ, উভয়ের মধ্যে অনৈক্য অশান্তি ও উপদ্রবের হেতু। শান্তি ও নিরূদ্রবে উভয়ের কল্যাণ অভন্নতি অনিবার্য। ৬৩।
চোর-রাজপুরুষেভ্যেবিত্তং রক্ষেৎ ॥ ৬৪ ॥
অনুবাদ : চোর, দস্যু, শঠ, প্রতারক প্রভৃতি হতে সৎ ও অসৎ এই উভয়বিধ উপায় দ্বারা ধন রক্ষা করবে। রাজপুরুষ হতে সদুপায় ও কৌশলে ধন রক্ষা করবে।
মর্মার্থ : সঞ্চিত ও উদ্বৃত্ত ধনের সদ্ব্যয় করা একান্ত উচিত। নিন্দনীয় বিষয়ে এবং বিলাস বিভ্রম পথে ধনব্যয় করা হিতকর নয়। ৬৪।
দুর্দর্শনা হি রাজানঃ প্রজা বিনাশয়ন্তি ॥ ৬৫ ॥
অনুবাদ : যে নৃপতিগণের দর্শন প্রজাদিগের পক্ষে দুঃখজনক, তারা প্রজার উচ্ছেদের হেতু হয়। ৬৫।
মর্মার্থ : প্রজাগণের অভাব, অভিযোগ, বিপদ, বিবাদ প্রভৃতি রাজার সমীপে নিবেদন করে প্রতিকার করতে হলে রাজসান্নিধ্য প্রয়োজন। তা যদি প্রজাগণের না ঘটে, তবে প্রজাসমূহের বিশেষহানি ও অশান্তি হয়। স্মৃতিশাস্ত্রে নিত্যরাজ সান্নিধ্য যে উপদ্রবেরহেতু বলেছে, তা নীতিও বিচারহীন রাজ বিষয়ে প্রযোজ্য। ৬৫।
ন্যায়বৰ্ত্তিনং রাজানং মাতরমিব মন্যন্তে প্রজাঃ ॥৬৬। ॥
অনুবাদ : প্রজাগণ ন্যায়শীল রাজাকে স্বীয় জননীর ন্যায় মনে করে। ৬৬।
মর্মার্থ : যে রাজা নীতি, ধর্ম ও সুবিচারসম্পন্ন হন, অনুগত প্রজাগণ তাকে স্বীয় মাতার ন্যায় জ্ঞান করে। জননী যেরূপ লালন, পালন, ভরণ, পোষণ, বিপদ হতে উদ্ধার প্রভৃতি দ্বারা পুত্রকে রক্ষা করে, রাজাও সে সকল বিষয়ে প্রজাকে তদ্রুপ সাহায্য করেন, এটি ন্যায়পরায়ণ বিবেকাসম্পন্ন রাজার কার্য। তার রাজ্যকে রাজনবান বলে। ৬৬।
তাদৃশঃ স রাজা ইহসুখং তত স্বৰ্গমাপ্নোতি ॥৬৭ ॥ অনুবাদ : পূর্বোক্ত রাজ্য ইহকাল সুখ ও পরকালে স্বর্গলাভ করে। ৬৭।
মর্মার্থ : ন্যায় ধর্মানুসারে প্রজাপালনই রাজার স্বধর্ম। সেই স্বধর্ম নিরত রাজা ঐহিক সুখ ও পারত্রিক স্বর্গলাভ করে। সৃষ্ট মানুষই কর্মানুরূপ ফলভাগী হয়। সৎকর্মানুষ্ঠানে সুফল অবশ্যম্ভাবী এটি নিঃসন্দেহ। ৬৭।
চৌরাংশ্চ কপ্টকাংশ্চ সততং নাশয়েৎ ॥ ৬৮ ॥
অনুবাদ : চোর ও ক্ষুদ্র শক্রসমূহকে উচ্ছেদ করবে। ৬৮।
মর্মার্থ : চোর, শত্রু, দস্যু, শঠ, লম্পট, প্রতারক, এরা রাজ প্রজাসাধারণের অনিষ্টসাধন করে থাকে। অতএব তাদের কৌশল ও বল দ্বারা নিবৃত্তি করা একান্ত প্রয়োজন। শত্রু, ব্যাধি, তস্কর, অগ্নি প্রভৃতির অবশেষ রাখবে না। পরিশেষ থাকলে তা হলে দ্বিগুণিত হয়ে আক্রমণ করে এবং তখন সেগুলো অনিবার্য হয়। ৬৮।
স্বধৰ্ম্মানুষ্ঠানদেব সুখমবাপ্যতে স্বৰ্গমবাপ্নোতি ॥ ৬৯ ॥
অনুবাদ : স্বীয় ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা ঐহিক সুখ পারত্রিক স্বর্গলাভ হয়। ৬৯।
মর্মার্থ : মহর্ষিকণাদ বলেছেন, যা হতে ঐহিক সুখ ও পারলৌকিক নিবৃত্তি লাভ হয়, তা ধর্ম। ধর্ম দ্বারা লোকের দুঃখ বা অবনতি ঘটে না। অধার্মিক ব্যক্তি লোকে অবিশ্বস্ত ও নিন্দনীয় হয়ে দুঃখভোগ করে পরন্তু সংসারে ঐহিক সুখ ও পারত্রিক নির্বাণ–এই দুটি লোকের প্রার্থনীয়। ৬৯।
অহিংসালক্ষণো ধর্মঃ ॥৭০ ॥
অনুবাদ : অহিংসাই ধর্মের লক্ষণ। ৭০।
মর্মার্থ : অহিংসা, সত্য, অচৌর্য, পবিত্রতা, ইন্দ্রিয় সংযম, এই পাঁচটি ধর্মের সাধারণ লক্ষণ। সমাজে হিংসা বিস্তার লাভ করলে, সে সমাজ সকল অনর্থের আকর হয়। ৭০।
অহিংসা পরমো ধর্ম্ম
अहिंसा परमं सत्यम अहिंसा परमं शरुतम॥
অহিংসা হল সর্বোচ্চ সত্য এবং পরম ধর্ম ॥
“অহিংসা পরম ধর্ম” – এই মহাজনোক্তি আমরা ছোটকাল হতে শুনে বড় হয়েছি। আমাদের রক্তমাংস অস্থিমজ্জায় এই বাণী প্রোথিত হয়ে আছে। অধিকাংশ ধর্মগুরুগণ আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই শ্লোকটি সম্পূর্ণ শ্লোক নয়, শাস্ত্রে লেখা সম্পূর্ণ শ্লোকটি নিচে দিচ্ছি:----
অহিংসা পরমো ধর্ম্ম, ধর্ম্ম হিংসা তথৈব চ ॥
অর্থাৎ অহিংসা মনুষ্য জীবনের পরম ধর্ম , এবং ধর্ম রক্ষার জন্যে হিংসা করা তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ ধর্ম ॥
অথবা
অহিংসা পরম ধর্ম কিন্তু ধর্মের রক্ষা হেতু হিংসা শ্রেয় ধর্ম ॥
অহিংসা পরম ধৰ্ম্মস্তথাহিংসা পরো দমঃ।
অহিংসা পরমং দানমহিংসা পরমং তপঃ॥
অহিংসা পরমাে যজ্ঞস্তথাহিংসা পরম ফলম্।
হিংসা পরমং মিত্রমহিংসা পরমং সুখম।
অহিংসা পরমং সত্যমহিংসা পরমং শ্রুতম্ ॥
সর্বযজ্ঞেসু বা দানং সর্বতীর্থেসু বাপ্লুতম।
সর্ব্বদানফলং বাপি নৈতত্তুল্যমহিংসয়া ॥
অহিংস্রোস্য তপােহক্ষয্যমহিংস্রোস্য যজতে সদা।
অহিংস্রঃ সর্বভূতানাং যথা মাতা যথা পিতা।।
এতৎ ফলমহিংসাযা ভূষশ্চ কুরুপুঙ্গব!।
ন হি শক্যা গুণা বক্তমপি বর্ষশতৈরপি ॥
[ মহাভারত অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় 101, শ্লোকঃ 37-41 ]
অনুবাদঃ
অহিংসা পরম ধর্ম, অহিংসা উত্তম ইন্দ্রিয়দমন, অহিংসা পরম দানের তুল্য এবং অহিংসা পরম তপস্যা॥ অহিংসা প্রধান যজ্ঞস্বরূপ, অহিংসা উত্তম ফলজনক, অহিংসা পরম বন্ধু- স্বরূপ, অহিংসা উত্তম সুখ উৎপাদন করে। অহিংসা পরম সত্যের তুল্য এবং অহিংসা বিশেষ শাস্ত্রজ্ঞানের সমান ॥ সমস্ত যজ্ঞে যে দান, সকল তীর্থে যে স্নান কিংবা সকল দানের যে ফল ; এই সমস্তও অহিংসার তুল্য নয়॥ হিংসাশূন্য মানুষের অক্ষয় তপস্যা হয়, হিংসারহিত মানুষ সর্বদাই যজ্ঞ করেন এবং হিংসা শূন্য লােক সমস্ত প্রাণীরই পিতা ও মাতার তুল্য হয়ে থাকে ॥
এই অহিংসার প্রচুর ফল ; অহিংসার সমস্ত গুণ শত বছরেও বলে শেষ করা যায় না ॥
…. [ মহাভারত অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় 101, শ্লোকঃ 37-41 ]
অহিংসা পরমো ধর্ম্ম । ধর্ম্ম হিংসা তথৈব চ ॥
কিন্তু হিংসা না করা মানুষের প্রকৃত ধর্ম কিন্তু ধর্ম রক্ষার প্রয়োজনে হিংসার আশ্রয়
নেওয়া তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ॥
উক্ত শ্লোকে বলা হয়েছে অনর্থক হিংসা করা নিষ্প্রয়োজন কিন্তু ধর্ম রক্ষার্থে হিংসা করাটাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তাই ধর্মের প্রয়োজনে, জাতির প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে অহিংসা নয়, হিংসাই কর্তর্ব্য।
আমাদের জানা উচিত কোন্ কোন্ ব্যক্তির প্রতি হিংসা করা উচিত।
আমাদের ধর্মশাস্ত্রে আততায়ী নামক ঘৃণ্য পশুদের বধের কথা বলা হয়েছে।তাহলে জেনে নেওয়া যাক আততায়ীর সংজ্ঞা কী..??
.
অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ ।
ক্ষেত্রদারাপহারী চ ষড়েতে হ্যাততায়িনঃ।।(বশিষ্ঠ স্মৃতি:৩/১৬)
অনুবাদ:
1. যে ঘরে আগুন দেয়
2. খাবারে বিষ দেয়
3.. ধারালো অস্ত্র দ্বারা হত্যা করতে উদ্যত
4. ধনসম্পদ অপহরণকারী
5..ক্ষেতখামার অপহরণকারী ও
6..ঘরের স্ত্রী অপহরণকারী – এই ছয় প্রকার দুষ্কৃতিকারীকে আততায়ী বলা হয়।
.
এই আততায়ীদের প্রতি কীরূপ আচরণ করতে হবে সে প্রসঙ্গে মনুসংহিতা বলছে-
গুরুং বা বালবৃদ্ধৌ বা ব্রাহ্মণং বা বহুশ্রুতম্।
আততায়িনমায়াস্তং হন্যাদেবাবিচারয়ন্।।(৮/৩৫০)
অনুবাদ: সেই আততায়ী যদি গুরু, বালক, বৃদ্ধ, বহুশ্রুত ব্রাহ্মণ অথবা অতিশয় বিদ্বান্ ব্যক্তিও হয় ,তবুও অগ্রসরমান্ সেই আততায়ীকে তখনই বধ করবে।
তাছাড়া যারা সনাতন ধর্ম পালন করতে দেয় না, তাদের প্রতি কীরূপ আচরণ করতে হবে তাও বলা আছে।
.
শস্ত্রং দ্বিজাতিভির্গ্রাহ্যং ধর্ম্মো যত্রোপরুধ্যতে।
দ্বিজাতীনাঞ্চ বর্ণানাং বিপ্লবে কালকারিতে।।(৮/৩৪৮)
আত্মনাশ্চ পরিত্রাণে দক্ষিণানাঞ্চ সঙ্গরে।
স্ত্রীবিপ্রাভ্যুপপত্তৌ চ ধর্ম্মেণ ঘ্নন্ ন দুষ্যতি।।(৮/৩৪৯)
অনুবাদ:--
: যখন সাহসকারীরা সনাতন ধর্ম্ম করতে না দেয়, তখন ব্রাহ্মণাদি ও তিন বর্ণ দুষ্টদমনের জন্য অস্ত্রগ্রহণ করবে এবং আত্মরক্ষার্থে ও যজ্ঞীয় দক্ষিণাদি উপদ্রব নিবারণার্থে কিংবা যুদ্ধ উপস্থিত হলে স্ত্রীলোকের রক্ষার জন্য অস্ত্রগ্রহণ করবেন।
সর্বত্র মান্যং ভ্রংশয়তি বালিশঃ ॥৭২ ॥
অনুবাদ : মূর্খ ব্যক্তি সকল বিষয়ে মাননীয় জনের সম্মানের হানি করে। ৭২।
মর্মার্থ : মূঢ় ব্যক্তি স্বীয় মানোপমান যেমন বুঝে না, সেরূপ মাননীয়জনের প্রতি সম্মান প্রকাশ করতেও পারে না, তা অজ্ঞতার পরিচয়। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি স্থান কাল, পাত্র বিচার পূর্বক সম্মানাদি প্রকাশ করে থাকে। ৭২।
ন সংসার-ভয়ং-জ্ঞানিনাম্ ॥ ৭৪
অনুবাদ : জ্ঞানিগণের সংসার-ভয় থাকে না। ৭৪।
মর্মার্থ : পরমেশের কৃপায় যাদের সকল জীবে সম বুদ্ধির প্রাদুর্ভাব হয়েছে, সেরূপ জ্ঞানিগণের আর সংসারে সুখ-দুঃখের ভয় থাকে না। তারা এই সুখ-দুঃখে তুচ্ছ বলে মনে করে। জ্ঞান ও চরিত্রবল দ্বারা বিপদকে ব্যাহত করে নির্ভীক থাকেন।
সৰ্বমনিত্যমধ্রুবম ॥ ৭৬ ॥
অনুবাদ : সকল বস্তু অনিত্য ও নশ্বর। ৭৬।
মর্মার্থ : দৃশ্যমান পদার্থ সকল অনিত্য, যার জন্ম হয়, অবশ্য সে বস্তুর বিনাশ আছে। দৃশ্যজগতের ব্যবহারিক নিত্যতা সম্বন্ধে কোনো বিবাদ নেই। সূত্রস্থ ‘অধ্রুব’ শব্দ দ্বারা কোনো বস্তু দীর্ঘকাল স্থায়ী হলেও, কালে অবশ্য তার বিনাশ হবে–এটি প্রদর্শিত হয়েছে। ৭৬।
কৃমিশকৃন্মুত্রভাজনং শরীরং পুণ্যপাপজন্মহেতুঃ ॥৭৮ ॥
অনুবাদ : এই শরীর কৃমি, মল, মূত্রের আধার, পুণ্য পাপের উৎপত্তি হেতু। ৭৮।
মর্মার্থ : এই পাঞ্চভৌতিক শরীর কীট, বিষ্ঠা, মূত্রের আধার রোগাদিতে পরাভূত হয় সময়ে, পঁচিয়া গলিয়া পড়ে। পঞ্চ ভূয়ো কার্য বলে তাতে ভৌতিক বিকার হয়। অসংযম ও যথেচ্ছাচারিতাই পাপের উৎপত্তির হেতু। সকার্য দ্বারা পুণ্য, গর্হিত কার্য দ্বারা পাপ জন্মে। স্থির বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি পাপের কাছে অগ্রসর হয় না। ৭৮।
জন্মমরণাদিষু দুঃখমেব ॥৭৯ ।
অনুবাদ : মানুষ, জন্ম, মৃত্যু জরা ব্যাধি দ্বারা নিত্যই দুঃখ ভোগ করে। ৭৯।
মর্মার্থ : সংসারে জন্ম, মরণ, শোক, তাপ, দৈন্য, ব্যাধি প্রভৃতি কার্য নিয়ত দুঃখ পেয়ে থাকে।
তস্মাৎ সুৰ্ব্বেষৎ কাৰ্যসিদ্ধিরিতি ॥ ৮২ ॥
অনুবাদ : তপস্যার অনুষ্ঠান দ্বারা সকল কার্যসিদ্ধ হয়। ৮২।
মর্মার্থ : তপঃ প্রভৃতিতে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, চিন্তাশীলতা দৃঢ় হয়, সে সমুদয় দ্বারা মানুষ অনায়াসে দুষ্কর কার্য সাধন করে।
অমর্ষেণোদ্ধতান্যাশু তেন শাস্ত্রমিদং কৃতম্।
বুদ্ধিরেব জয়ত্যেকা পুংসঃ সর্বার্থ সাধনী।
অনুবাদ : পুরুষের অন্তরে ও বাইরের সকল কার্য সাধনাকারী একমাত্র প্রখর বুদ্ধি শক্তি। যে বুদ্ধির নৈপুণ্যে সুধী শিরোমণি, তার কোন কোন কার্য না সাধন করেছেন?
বিহিতেষু তদন্যেষু মনোবাক-কায় কৰ্ম্মভিঃ।
প্রবৃত্তৌ বা নিবৃত্তৌ বা একরূপত্বমার্জ্জবম্ ॥
অনুবাদ : মহাপুরুষের বিহিত ও অবিহিত কিংবা সাধারণ কার্যে অর্থাৎ ন্যায্য এবং অন্যায় কার্যে প্রবৃত্তি বিষয়ে হোক অথবা নিবৃত্তি বিষয়ে হোক, বাক্য, মন, শরীর এবং ক্রিয়ার একরূপ, ব্যবহার হয়ে থাকে। কখনো মনে একরূপ, মুখে অন্যরূপ, কার্যে ভিন্নরূপ হয় না–এই মহত্ত্বের পরিচায়ক ॥
স্বধৰ্ম্মানুষ্ঠানদেব সুখমবাপ্যতে স্বৰ্গমবাপ্নোতি ॥ ৬৯ ॥
অনুবাদ : স্বীয় ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা ঐহিক সুখ পারত্রিক স্বর্গলাভ হয়। ৬৯।
মর্মার্থ : মহর্ষিকণাদ বলেছেন, যা হতে ঐহিক সুখ ও পারলৌকিক নিবৃত্তি লাভ হয়, তা ধর্ম। ধর্ম দ্বারা লোকের দুঃখ বা অবনতি ঘটে না। অধার্মিক ব্যক্তি লোকে অবিশ্বস্ত ও নিন্দনীয় হয়ে দুঃখভোগ করে পরন্তু সংসারে ঐহিক সুখ ও পারত্রিক নির্বাণ–এই দুটি লোকের প্রার্থনীয়। ৬৯।