জন্মাষ্টমী ব্রত সময় বা কাল– ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই ব্রত পালন করতে হয়। স্ত্রী ও পুরুষ সকলেই এই ব্রত পালন করতে পারে।
জন্মাষ্টমী ব্রতের দ্রব্য ও বিধান—তিল, ফুল, তুলসী, দূর্বা, ধূপ, দীপ, পঞ্চগব্য, পঞ্চগুঁড়ি, আতপচালের নৈবেদ্য, ফলের নৈবেদ্য, পাট, বালি, মধুপর্কের বাড়ি, আসন, অঙ্গুরী, পূর্ণপাত্র, দই, মধু, চিনি, তেল ও হলুদ।
জন্মাষ্টমী ব্রতের আগের দিন নিরামিষ খেয়ে সংযম করে থাকতে হবে আর ব্রতের দিন উপোস করতে হবে। কুলপুরোহিতকে দিয়ে পুজো করিয়ে দক্ষিণা দিয়ে ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে প্রসাদ গ্রহণ করবে।
জন্মাষ্টমী ব্রতকথা— মথুরায় উগ্রসেন নামে এক অতি ধার্মিক রাজা ছিলেন। তাঁর ছেলে কংস এক সময় খুব অত্যাচারী হয়ে উঠল। সে তার বাবার রাজসিংহাসন জোর করে কেড়ে নিল।
তারপর সে মহাদেবকে আরাধনায় সন্তুষ্ট করে বর পেল যে, শুধুমাত্র নিজের বোনের অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতেই সে মরবে, অন্য আর কারুর হাতে তার মৃত্যু নেই। এই বর পাবার পর তার সাহস আর অত্যাচার অনেক গুণ বেড়ে গেল।
শেষে অন্য সব অসুরদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সে প্রচার করে দিল যে, রাজ্যে কেউ হরিনাম করতে পারবে না যে হরিনাম করবে তার আর রক্ষে নেই।
তারপর সে তার বোন দেবকী আর তার স্বামী বসুদেবকে এনে কারাগারে বন্দী করে রাখল, কারণ সে জানত যে, তার বোন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতেই তার মৃত্যু হবে।
এইভাবে কারাগারে থাকতে থাকতে দেবকীর সাতটি ছেলে হল আর কংস প্রত্যেকটিকে কারাগার থেকে নিয়ে গিয়ে পাথরের ওপর আছাড় মেরে তাদের ফেরে ফেলল।
শেষে যখন কংস খবর গেল এইবার দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান হবে তখন সে কারাগারের চারিদিকে খুব কড়া পাহারার ব্যবস্থা করল।
এরই মধ্যে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে গভীর রাত্তিরে নারায়ণ ভূমিষ্ঠ হলেন দেবকীর কোলে। নারায়ণের শ্যামবর্ণ চতুর্ভুজ মূর্তি দেখে দেবকী আর বসুদেব এক্কেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বসুদেব খুবই কাতরভাবে ভগবানকে ডাকতে লাগলেন
এই ছেলেটিকে রক্ষা করবার জন্যে।
এই সময়ে কারাগারে এক দৈববাদী -বসুদেব। আমার মায়ায় এখন সমস্ত পৃথিবীর লোক ঘুমে অচেতন হয়ে আছে- তুমি এই মুহূর্তে গোকুলে নন্দের বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে এই শিশুটিকে রেখে এসো আর নদের স্ত্রী যশোমতীর এইংশে একটি মেয়ে হয়েছে, তাকে নিয়ে এসে দেহরীর কোলে শুইয়ে দাও।
ঘুমে আচ্ছন্ন পৃথিবীর কেউ কিছুই জানতে না।”শোনার পর বসুদের আর দেরি না করে কৃষ্ণকে কোলে করে। নদের বাড়ি যাবার জন্যে বেরিয়ে পড়লেন। প্রহরীরা সকলেই তখন ঘুমে অচেন, কেউ কিছুই জানতে পারল না।
বসুদের গিয়ে পৌঁছালেন যমুনার তীরে। এই সময়ে হল, যমুনার | দুকূল ছাপিয়ে উঠেছিল আর ভয়ানক বিদ্যুৎ ছিল। এই দুর্যোগ দেখে বসুদেবের মনে ভীষণ ভয় হল। এই অবস্থায় যমুনা পার হওয়া অসম্ভব দেখে তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
কিন্তু নারায়ণ তার মায়া ছড়িয়ে দিয়েছিলেন চারিদিকে। এই সময়ে বসুদেবের চোখে পড়ল যে, যমুনার জল হঠাৎ কমে গিয়ে হাঁটু সমান হয়ে গেছে আর একটা শিয়াল অনায়াসে যমুনা পার হয়ে যাচ্ছে।
বসুদেবও তখনই চললেন শিয়লাটার পিছনে পিছনে। বসুদের ও তার সন্তানকে ভীষণ বৃষ্টি থেকে বাঁচাবার জন্যে নাগরাজ তার বিশাল ফলা বিস্তার করে ধরলেন তাদের মাথার ওপরে।
এইভাবে অল্প সময়ের মধ্যে বসুদের কৃষ্ণকে যশোমতীর কোলের কাছে রেখে মেয়েটিকে নিয়ে আবার কারাগারে ফিরে এলেন ও মেয়েটিকে অর্থাৎ দেবী যোগমায়াকে দেবকীর কোলে রেখে দিলেন।
সকাল হতেই কংস খবর পেল যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান একটি মেয়ে হয়েছে। কংস তখনি দেবকীর কোল থেকে জোর করে মেয়েটিকে কেড়ে নিল।
মেয়ে বলে তাকে ছেড়ে দেবার জন্যে দেবকী অনেক অনুনয় বিনয় করল; কিন্তু কংস কোনো কথাই শুনন না। সে যেমনি মেয়েটিকে পাথরের ওপর আছাড় মারতে গেল সেই মুহূর্তেই তার হাত থেকে মেয়েটি শূন্যে উঠে গিয়ে যোগমায়া মূর্তি ধারণ করে শূন্যে মিলিয়ে গেলেন। যাবার সময় তিনি কংসকে বলেন গেলেন, “তোমারে বধিবে যে—গোকুলে বাড়িছে সে।
তারণর সময় পূর্ণ হতে কংস শ্রীকৃষ্ণের হাতেই বধ হয়েছিল। এই পুণ্যময় ব্রতকথা, যে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা মীর দিন উপোস করে থেকে মন দিয়ে শোনে, তার সাতজন্মের পাপ নাশ হয়, অন্তিমকালে তার বৈকুণ্ঠ লাভ হয়ে থাকে।
জন্মাষ্টমী ব্রতের ফল— জন্মাষ্টমী ব্রত, স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই পালনের অধিকারী। এই দিন শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে দিনটি খুবই শুভ। এই ব্রত পালন করলে সমস্ত পাপ ও অকল্যাণ দূর হয়।
শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন। ১
যশোদা রাখিল নাম যাদু বাছাধন ॥ ২
উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর-গোপাল । ৩
ব্রজবালক নাম রাখে ঠাকুর-রাখাল ॥ ৪
সুবল রাখিল নাম ঠাকুর কানাই । ৫
শ্রীদাম রাখিল নাম রাখাল রাজা ভাই ॥ ৬
ননীচোরা নাম রাখে যতেক গোপিনী । ৭
কালসোণা নাম রাখে রাধাবিনোদিনী ॥ ৮
কুব্জা রাখিল নাম পতিত-পাবন হরি । ৯
চন্দ্রাবলী নাম রাখে মোহন-বংশীধারী ॥ ১০
অনন্ত রাখিল নাম অন্ত না পাইয়া । ১১
কৃষ্ণ নাম রাখে গর্গ ধ্যানেতে জানিয়া ॥ ১২
কম্বমুনি নাম রাখে দেবচক্রপাণি। ১৩
বনমালী নাম রাখে বনের হরিণী ॥ ১৪
গজহস্তী নাম রাখে শ্রীমধুসূদন । ১৫
অজামিল নাম রাখে দেব নারায়ণ ॥ ১৬
পুরন্দর নাম রাখে দেব শ্রীগোবিন্দ । ১৭
দ্রৌপদী রাখিল নাম দেব দীনবন্ধু ॥ ১৮
সুদাম রাখিল নাম দারিদ্র্য-ভঞ্জন । ১৯
ব্রজবাসী নাম রাখে ব্রজের জীবন ॥ ২০
দর্পহারী নাম রাখে অর্জুন সুধীর। ২১
পশুপতি নাম রাখে গরুড় মহারীর ॥ ২২
যুধিষ্ঠির নাম রাখে দেব যদুবর। ২৩
বিদুর রাখিল নাম কাঙ্গালের ঠাকুর ॥ ২৪
বাসুকী রাখিল নাম দেব-সৃষ্টি স্থিতি। ২৫
ধ্রুবলোকে নাম রাখে ধ্রুবের সারথি ॥ ২৬
নারদ রাখিল নাম ভক্ত-প্রাণধন। ২৭
ভীষ্মদেব নাম রাখে লক্ষ্মী-নারায়ণ ॥ ২৮
সত্যভামা নাম রাখে সত্যের সারথি। ২৯
জাম্ববতী নাম রাখে দেব যোদ্ধাপতি ॥ ৩০
বিশ্বামিত্র নাম রাখে সংসারের সার। ৩১
অহল্যা রাখিল নাম পাষাণ-উদ্ধার ॥ ৩২
ভৃগুমুনি নাম রাখে জগতের হরি । ৩৩
পঞ্চমুখে রামনাম গান ত্রিপুরারি ॥ ৩৪
কুঞ্জকেশী নাম রাখে বলি সদাচারী । ৩৫
প্রহ্লাদ রাখিল নাম নৃসিংহ মুরারি ॥ ৩৬
বশিষ্ঠ রাখিল নাম মুনি-মনোহর। ৩৭
বিশ্বাবসু নাম রাখে নবজলধর ॥ ৩৮
সম্বর্ত্তক রাখে নাম গোবর্দ্ধনধারী । ৩৯
প্রাণপতি নাম রাখে যত ব্রজনারী ॥ ৪০
অদিতি রাখিল নাম আরতি-সুদন । ৪১
গদাধর নাম রাখে যমল-অর্জ্জুন ।। ৪২
মহাযোদ্ধা নাম রাখে ভীম মহাবল। ৪৩
দয়ানিধি রাখে নাম দরিদ্র সকল । ৪৪
বৃন্দাবন-চন্দ্র নাম রাখে বৃন্দাদুতী । ৪৫
বিরজা রাখিল নাম যমুনার পতি। ৪৬
বাণীপতি নাম রাখে গুরু বৃহস্পতি । ৪৭
লক্ষ্মীপতি নাম রাখে নাম সুমন্ত্র সারথি ।। ৪৮
সন্দীপনি নাম রাখে দেব অন্তর্যামী। ৪৯
পরাশর নাম রাখে ত্রিলোকের স্বামী।। ৫০
পদ্মযোনি নাম রাখে অনাদির আদি । ৫১
নট নারায়ণ নাম রাখিল সম্বাদী ।।৫২
হরেকৃষ্ণ নাম রাখে প্রিয় বলরাম। ৫০
ললিতা রাখিল নাম দু্র্ব্বাদলশ্যাম ।। ৫৪
বিশাখা রাখিল নাম অনঙ্গমোহন। ৫৫
সুচিত্রা রাখিল নাম শ্রীবংশীবদন। ৫৬
আযান রাখিল নাম ক্রোধ-নিবারণ। ৫৭
চণ্ডকশী নাম রাখে কৃত্তান্ত শাসন ॥ ৫৮
জ্যোতিষ্ক রাখিল নাম নীলকান্তমণি। ৫৯
গোপীকান্ত নাম রাখে সুদাম-ঘরণী। ৬০
ভক্তগণ নাম রাখে দেব জগন্নাথ। ৬১
দূর্ব্বাসা রাখেন নাম অনাথের নাথ। ৬২
রাসেশ্বর নাম রাখে যতেক মালিনী। ৬৩
সর্ব্ব-যজ্ঞেশ্বর নাম রাখেন শিবানী। ৬৪
উদ্ধব রাখিল নাম মিত্রহিত কারী । ৬৫
অক্রুর রাখিল নাম ভব ভয় সাথী।। ৬৬
গুঞ্জমালী নাম রাখে নীল পীতবাস । ৬৭
সর্ব্ববেত্তা রাখে নাম দ্বৈপায়ন ব্যাস।। ৬৮
অষ্টসখী নাম রাখে ব্রজের ঈশ্বর। ৬১
সুরলোকে রাখে নাম অখিলের সার। ৭০
বৃষভানু নাম রাখে পরম ঈশ্বর। ৭১
স্বর্গবাসী রাখে নাম দেব পরাৎপর। ৭২
পুলোমা রাখেন নাম অনাথের সখা। ৭৩
রসসিন্ধু নাম রাখে সখী চিত্রলেখা। ৭৪
চিত্ররথ নাম রাখে আরতি দমন। ৭৫
পুলস্ত্য রাখিল নাম নয়ন-রঞ্জন ॥ ৭৬
কশ্যপ রাখেন নাম রাস রাসেশ্বর। ৭৭
ভাণ্ডারীক নাম রাখে পূর্ণ-শশধর ॥ ৭৮
সুমালী রাখিল নাম পুরুষ-প্রধান । ৭৯
পুরঞ্জন নাম রাখে ভক্তগণ প্ৰাণ ॥ ৮০
রজকিনী নাম রাখে নন্দের-দুলাল। ৮১
আহ্লাদিনী নাম রাখে ব্রজ়ের-গোপাল ॥ ৮২
দৈবকী রাখিল নাম নয়নের মণি। ৮৩
জ্যোতির্ময় নাম রাখে যাজ্ঞবল্ক্য মুনি ॥ ৮৪
অত্রিমুনি নাম রাখে কোটি চন্দ্রেশ্বর । ৮৫
গৌতম রাখিল নাম দেব বিশ্বম্ভর ।।৮৬
মরীচি রাখিল নাম অচিন্ত্য অচ্যুত। ৮৭
জ্ঞানাতীত নাম রাখে সৌনকাদি সুত ॥ ৮৮
রুদ্রগণ নাম রাখে দেব মহাকাল। ৮৯
বসুগণ রাখে নাম ঠাকুর দয়াল ॥ ৯০
সিদ্ধগণ নাম রাখে পুতনা-নাশন । ৯১
সিদ্ধার্থ রাখিল নাম কপিল তপোধন ॥ ৯২
ভাগুরি রাখিল নাম অগতির গতি। ৯৩
মৎস্যগন্ধা নাম রাখে ত্রিলোকের পতি ॥ ৯৪
শুক্রাচার্য্য রাখে নাম অখিল বান্ধব । ৯৫
বিষ্ণুলোকে নাম রাখে দেব শ্রীমাধব ॥ ৯৬
যদুগণ নাম রাখে যদুকুলপতি । ৯৭
অশ্বিনীকুমার নাম রাখে সৃষ্টি-স্থিতি ॥ ৯৮
অর্য্যমা রাখিল নাম কাল-নিবারণ । ৯৯
সত্যবতী নাম রাখে অজ্ঞান-নাশন ॥ ১০০
পদ্মাক্ষ রাখিল নাম ভ্রমর-ভ্রমরী । ১০১
ত্রিভঙ্গ রাখিল নাম যত সহচরী ॥ ১০২
বঙ্কচন্দ্র নাম রাখে শ্রীরূপমঞ্জরী । ১০৩
মাধুরী রাখিল নাম গোপী-মনোহারী ॥ ১০৪
মঞ্জুমালী নাম রাখে অভীষ্ট-পূরণ । ১০৫
কুটিলা রাখিলা নাম মদন-মোহন ॥ ১০৬
মঞ্জুরী রাখিল রাম কৰ্ম্মবন্ধ-নাশ । ১০৭
ব্রজবন্ধু নাম রাখে পূর্ণ-অভিলাষ ॥ ১০৮
ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রাধাষ্টমী ব্রত নিতে হয়। (মনে রাখবেন কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রী কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী আর শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রাধাষ্টমী ব্রত।) সমস্ত স্ত্রীলোকেরা রাধাষ্টমী ব্রত করে থাকে। এছাড়া সমস্ত শ্রী রাধা ভক্তরা ও এই ব্রত নিতে পারেন।
রাধাষ্টমী ব্রতের দ্রব্য ও বিধান— গন্ধ ফুল, আতপচাল, সিদ্ধচাল, নৈবেদ্য, আট রকম আটটি ফল প্রভৃতি। ব্রতের আগের দিন নিরামিষ ভোজন করতে হবে এবং ব্রতের দিন উপোস করে থেকে
শ্রীরাধিকা, ললিতা, বৃন্দা আদি অষ্টসখী, বৃষভানু, নন্দ প্রভৃতির পুজো করতে হয়। ব্রতের পরের দিন ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের ভোজন করিয়ে যথা সাধ্য ভোজন দক্ষিণা দেওয়া ব্রত পালনের নিয়ম।
রাধাষ্টমী ব্রতকথা— এক সময় সূর্যদেব শ্রীকৃষ্ণের তপস্যা করতে থাকেন। বহুদিন ধরে সূর্য এইভাবে তপস্যায় ব্যস্ত থাকার ফলে পৃথিবী একেবারে অন্ধকারে ডুবে রইল। তার ফলে, সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবার উপক্রম হল।
এই অবস্থার দরুন দেবতারা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারা শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়ে সৃষ্টি রক্ষার জন্যে এর বিহিত করতে তাকে অনুরোধ করলেন। দেবতাদের কথা শোনার পর শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বললেন “তোমরা নিশ্চিন্তে থাকো, আমি শিগগিরই এর একটা বিহিত করছি।”
তারপর শ্রীকৃষ্ণ সূর্যের কাছে গিয়ে বললেন, “তোমার তপস্যা সিদ্ধ হয়েছে, এখন তুমি বর প্রার্থন কর।” সূর্য তখন বললেন, হে বিশ্বপতি! আমাকে এই বর দিন যে—আমার যেন একটি মেয়ে হয়, আর আপনি সেই মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবেন।”
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “তাই হবে দিবাকর। দ্বাপর যুগে তুমি গোকুলে বৃষভানু হয়ে গোপের মেয়ে সুকীর্তিকে বিয়ে করবে। তার গর্ভে ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে একটি মেয়ে জন্মাবে।
সেই মেয়ের নাম রাখা হবে রাধিকা আর আমিও রাধিকার প্রতি আকৃষ্ট হবো। যাও, এখন অন্ধকার সরিয়ে সৃষ্টিকে রক্ষা করো।” নিজের প্রার্থনা মতো বর পেয়ে সূর্যও সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলেন।
ক্রমে গোকুলে বৃষভানুর বাড়িতে উঠল এক আনন্দের রোল। বৃষভানুর স্ত্রী সুকীর্তি একটি মেয়ে প্রসব করল। সকলের খুব আনন্দ হল। পরে সেই মেয়ের নাম রাখা হল রাধিকা।
ধীরে ধীরে সময় কেটে গিয়ে রাধিকার বিয়ের বয়স উপস্থিত হল, অয়ন ঘোষের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে রাধিকা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে গোপনে বিহার করতে থাকলেন।
এর কারণ, শ্রীকৃষ্ণ আর রাধিকা একই আত্মা। রাধিকার গোপনে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মেলামেশার দিনগুলি নানা উৎসবে পূর্ণ ছিল আর বৃন্দাবনে দোললীলা, রাসলীলা, নৌকাবিলাস ইত্যাদি নামে আনন্দের সঙ্গে পালন করা হত।
ভাদ্র মাসের রাধাষ্টমীর দিনে যদি কেউ শ্রীরাধিকার পুজো করে, তাহলে শ্রীকৃষ্ণ তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হন, তিনি তার মনস্কামনা অবিলম্বে পূর্ণ-করেন।
শ্রীকৃষ্ণ নিজ মুখেই বলেছেন, “আমার নাম হাজার বার জপ করলে লোক যে ফল পায়—সেই ফল পাওয়া যায় মাত্র একবার রাধাকৃষ্ণ নাম জপ করলে।”
তাই তাই সকলে মিলে একবার বলুন “জয় শ্রী রাধাকৃষ্ণ, জয় শ্রী রাধাকৃষ্ণ”
রাধাষ্টমী ব্রতের ফল – শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধাকে সন্তুষ্ট করার জন্য, স্ত্রীলোকেরা এই ব্রত নিয়ে থাকে। এই ব্রত পালন করার ফলে, সংসার শাস্তিতে পরিপূর্ণ থাকে।
তালনবমী ব্রতের সময় বা কাল – ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে এই ব্রত করতে হয়। সমস্ত সধবা স্ত্রীলোকেরাই এই ব্রত পালন করে থাকে।
তালনবমী ব্রতের দ্রব ও বিধান- ঘট কলসী, ধূপ, দীপ, ফুল, নৈবেদ্য, ৯টি ফল ও মিষ্টার, উদ্যাপনের সময় ব্রাহ্মণকে একখানি নতুন কাপড় ও ১টি টাকা দক্ষিণা দেওয়া প্রয়োজন। একটি পরিষ্কার জায়গায় মণ্ডপ তৈরী করে সেখানে
বেশ করে আলপনা দেওয়ার পর, তার ওপর ঘট বসিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণের পুজো করবে, পিঠে তৈরী করে সকালে নারায়ণের ভোগ দিতে হবে, ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে হবে,
তারপর নিজের স্বামীকে খাইয়ে এযোত্রীলোকেরা নিজে আহার করবে। এই রঙের এই নিয়ম পালন করতে হয়। ব্রত উদযাপনের সময় ৯ বছর।
তালনবমী ব্রতকথা— দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের রুক্মিণী আর সত্যভামা নামে দুই স্ত্রী ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ এঁদের মধ্যে রুক্মিণীকেই একটু বেশী ভালবাসতেন।
এতে সত্যভামার মনে কোন সুখ ছিল না। মনে খুব কষ্ট হওয়ার ফলে, সত্যভামা একদিন তপোবনে গিয়ে একজন তপস্বীকে নিজের দুঃখের কথা জানালেন এবং কী করে তার এই মনোকষ্টের লাঘব হবে তার উপায় বলে দিতে অনুরোধ করলেন।
সাধক তপস্বী বললেন, “দ্যাখো মা, একটি ব্রত ঠিক ঠিক ভাবে করতে পারলে, তোমার মনে আর কোনো দুঃখ-কষ্টই থাকবে না।”
সত্যভামা তখন বললেন, “আপনি আমাকে সেই ব্রতের নিয়ম বলে দিন। আমি সেই ব্রত নিশ্চয় পালন করব।” তপস্বী বললেন, “ব্রতটির নাম তালনবমী ব্রত।
ভাদ্র মাসে শুরুপক্ষের নবমী তিথিতে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে লক্ষ্মী-নারায়ণের পুজো করবে। ব্রতটি তালনবমী ব্রত বলে এই ব্রতে তাল ফল দান করা বিশেষ প্রয়োজন।
এই ব্রত পালনের অঙ্গ হিসেবে সধবা স্ত্রীলোকেরা প্রথমে নিজের স্বামীকে খুব যত্নের সঙ্গে পিঠে তৈরী করে খাওয়াবে, পরে ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে সব শেষে নিজেরাও খাবে।
ন’বছর ঠিক নিয়মে আর নিষ্ঠার সঙ্গে এই ব্রত পালন করে উদ্যাপন করলে ছেলে-নাতি-নাতনী ও প্রচুর ধন-সম্পত্তি বৃদ্ধি হয়ে থাকে সৌভাগ্যেরা আর শেষ থাকে না।
তপস্বীর কাছে সব শুনে সত্যভামা বাড়িতে ফিরে এসে তপস্বীর কথামতো ন’বছরধরে তাল নবমীর ব্রত পালন করলেন।
তাঁর ব্রত উদযাপন হওয়ার সময় নারায়ণ তার কাছে এলেন ও বললেন, “এতদিনে তোমার দুর্ভাগ্যের দিন শেষ হল। আমি বর দিচ্ছি। তুমি সৌভাগ্যবতী হয়ে খুব সুখে শান্তিতে দিন কাটাবে।”
সেই থেকে সত্যভামার মনে আর কোনো দুঃখ রইল না, শ্রীকৃষ্ণের প্রেম-ভালবাসা পেয়ে তিনি দিন কাটাতে লাগলেন।
তালনবমী ব্রতের ফল – ভাদ্র মাসে এয়োস্ত্রীরা এই তালনবমী ব্রত করলে তাদের কোন দুঃখ-কষ্ট থাকে না এবং তারা স্বামী সোহাগিনী হয়ে থাকে।
দূর্বাষ্টমী ব্রতের সময় বা কাল- ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই ব্রত করতে হয়, আর স্ত্রীলোকেরাই এই ব্রত পালন করে থাকে।
দূর্বাষ্টমী ব্রতের দ্রব্য ও বিধান – ধূপ, ধুনো, দীপ, আটটি ফল, নৈবেদ্য, হরিতকী, মিষ্টান্ন, খেজুর, নারকেল, আঙ্গুর, ডালিম, বেদানা, কমলালেবু প্রভৃতি।
এই ব্রত শেষ করে বংশবৃদ্ধি হওয়ার কামনা করতে হয়। এই ব্রত পালনের সময় ব্রাহ্মণকে পৈতে, পয়সা,হরিতকী, মিষ্টি প্রভৃতি দেওয়া অবশ্য কর্তব্য।
দূর্বাষ্টমী ব্রতকথা— এক সময়ে শ্রীকৃষ্ণ রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে এই ব্রতকথা বলেছিলেন। যখন সমুদ্র মন্থন করা হয়, সেই সময় স্বয়ং নারায়ণ নিজের হাত আর জানুর সাহায্যে, মন্দর পর্বতকে ধরে থেকে সমুদ্র মন্থন করিয়েছিলেন।
মন্দর পর্বতের সঙ্গে রগড়ে যাওয়ার ফলে তার দেহের লোমগুলো ঘসে ঘসে সমুদ্রের জলে পড়েছিল, আর সেইগুলো ভাসতে ভাসতে তীরে পৌঁছে দুর্বা হয়ে পৃথিবীতে জন্মেছিল।
আবার দেবতা আর অসুরেরা যখন অমৃত সংগ্রহ করার জন্যে সমুদ্র মন্থন করেন সেই সময়েও দুর্বার ওপর কয়েক ফোঁটা অমৃত পড়েছিল, তার ফলে দূর্বা দেবতাদের অতি প্রিয় আর অমর হয়েছিল।
ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতে খেজুর, নারকেল, আঙ্গুর, হরিতকী, ডালিম, বেদানা, কমলালেবু প্রভৃতি ফল, ধূপ, দীপ, ফুল ও গন্ধ ও নৈবেদ্য দিয়ে দুর্বার পুজো করতে হয়।
এই পুজোর মন্ত্র হিসেবে বলতে হয়, “হে দূর্বা তুমি দেব ও অসর সকলেরই প্রিয় ও পূজনীয়া। তুমি যেন, নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে অমর হয়ে এই পৃথিবীতে রয়েছো— তেমনি আমার সন্তানদেরও অমর করে দাও।”
বহু প্রাচীন যুগে দেবতারা, পার্বতী, রতি, সরস্বতী, গঙ্গা, দিতি, অদিতি, মন্দোদরী, চণ্ডী, দীপ্তা, মায়া, রেবর্তী, দময়ন্তী, মেনকা, রম্ভা আর ঋষিদের মেয়েরা দূর্বার পুজো করতেন।
খুব শুদ্ধ মনে ভক্তির সঙ্গে নিয়ম অনুসারে দুর্বার পুজো করে ব্রাহ্মণকে ভুজি, কাপড়, ফল ও দক্ষিণা দিতে হয়, পরে আত্মীয় কুটুম্বদের পরিতৃপ্ত করে ভোজন করিয়ে নিজে ভোজন করতে হয়।
যে স্ত্রীলোক সন্তান প্রাপ্তি বা বংশ বৃদ্ধি ও সন্তানদের দীর্ঘজীবন পাওয়ার জন্যে এই ব্রত করে, সে ইহলোকে স্বামী-পুত্র নিয়ে সুখে-শান্তিতে দিন কাটায় আর দোন্তে শ্রীবিষ্ণুর চরণ লাভ করে থাকে।
দূর্বাষ্টমী ব্রতের ফল— ভাদ্র মাসে যে দূর্বাষ্টমী ব্রত পালন করে—সংসারে তাকে কোনোদিন দুঃখ ও শোক ভোগ করতে হয় না।